অনন্ত ফাঁদ!!
এই যে বহুচর্চিত নেট-জেট গতির যুগ,এটি ঠিক কী?স্বল্প কথায় একে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়।তবে এই যুগের একটি স্তর অবশ্যই আমি নিজে যা নই,নিজেকে তার চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় প্রকরণে বৃহত্তর সমাজে উপস্থাপিত করা। আত্মজাহির,আত্মবিপণনের এক প্রাণান্তকর দৌড় চলছে সমাজে।আসলে মানুষকে এই পথে ধাবিত করছে বাজার।আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বাজারের অনন্ত গহ্বর।এ বাজার পণ্যের হতে পারে,হতে পারে ভোট-রাজনীতির। যেন-তেন-প্রকারে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের বাসনা।’ইনার রিয়্যালিটি’ অনেক পরের বিষয়, আগে ‘সারফেস রিয়্যালিটি।’
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে আদতে এক অদৃশ্য ওজনের চাপে নিয়ত পিষ্ট হয়ে চলেছে মানুষ।বাজার মানুষকে বাধ্য করছে শরীরের পণ্যায়ন থেকে শুরু করে পরিবেশনা ও অনুপ্রাণিত-অনুকরণে মগ্ন থাকতে।এমনকী নিজের ঈশ্বরপ্রদত্ত আকার,আয়তন নিয়েও এক অসম আচ্ছন্নতায় মগ্ন মানুষ।ব্যক্তি মানুষ যদি এভাবে আরও আত্মকেন্দ্রিক হতে শুরু করে, তবে আগামী দিনে সমষ্টির বিবেক-বোধ ইত্যাদি কোথায় গিয়ে ঠেকবে,আমাদের জানা নেই।অথচ সত্য এই যে, আত্মকেন্দ্রিকতার এই অনুশীলন,অর্থ ও সময় ব্যয় এবং তা থেকে পাওয়া বিপুল আত্মতুষ্টির অনুভবের কোনও শেষ নেই।কারণ, কামনার ভিত্তিই হলো চির-অতৃপ্ততা, ‘আরও চাই’
মনোভাব।
মানুষ ভুলে যাচ্ছে,অথবা তাকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে শরীরকেন্দ্রিক -এই আত্ম-উন্নতির অনুপ্রেরণার পিছনে যে দৃশ্যগত সূত্রগুলি রয়েছে,তারা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নাগালের আলোকবর্ষ বাইরে।যে তারকা বা মডেল সুগন্ধি,স্বপ্ন বা গাড়ি বেচতে প্রলুব্ধ করছেন,সেই মহিমা তার নিজস্ব নয়।তার পিছনে রয়েছে চড়া কৃত্রিম আলো, প্রসাধন, যান্ত্রিক সম্পাদনার কারসাজি, বিপুল পুঁজির সমাবেশ।সে পুঁজির একমাত্র লক্ষ্য আমাদের মনোযোগে ভাগ বসানো।মোহ ও আচ্ছন্নতার প্রলেপে আমাদের ভুলিয়ে রাখাই বিজ্ঞাপন ও বাজারের অন্যতম উদ্দেশ্য। যার অমোঘ ডাকে আমাদের ক্রেতা-সত্তা সহজেই উত্তেজিত ও জাগ্রত হয়। আমরা বিশ্বাস করে ফেলি পণ্যের প্রতিশ্রুতিতে, সাড়া দিই তার আহ্বানে।আমরা মেনে নিই নিদাগ ত্বকের আশ্বাস, সৌন্দর্য ও বিলাসের আরও কত বিজ্ঞাপনী দাবি।বাজারের দাবি,মতান্তরে বাণিজ্যিক দর্শনটি একরৈখিক।শরীর এবং মনকে পরিণত করতে হবে এক উন্নত ও উৎকৃষ্ট পণ্যে। যেন সেটিই জীবনের লক্ষ্য, সাফল্যের মাপকাঠি এবং উত্তেজনার চাবিকাঠি।সেটিই দৃষ্টি আকর্ষণের মূলমন্ত্র, অতৃপ্ত যৌনতায় প্রলেপ। শরীরকে সযত্নে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলে শুধু চলবে না; রাখলে,তবেই তা হতে পারে প্রদর্শনযোগ্য বা পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত। বাজার, বিজ্ঞাপন ও পণ্যেরা এ কাজটা বিভিন্ন স্তরে নিষ্ঠার সঙ্গে বেচে। বাজার প্রতিনিয়ত আমাদের মনে করায়, আপনার শরীরে বহু ঘাটতি: ব্রণ, দাগ, চর্বি, অবাঞ্ছিত রোম, চুল পাতলা হয়ে আসা, চামড়ার রুক্ষতা, ত্বকের শ্যামবর্ণ, মুখের আদল, নাকের গড়ন, ভোঁতা চিবুক, অপর্যাপ্ত বাঁক, থলথলে মাংস, দেব-দিবে অভক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব অবিলম্বে প্রয়োজন স্ব-নিয়ন্ত্রণ,সেই সব সামগ্রীর ব্যবহার যা ওই খামতি মুছে বা ঢেকে দেবে, বাড়াবে আত্মবিশ্বাস।তা হলে আর জনসমক্ষে আপনাকে লজ্জায় পড়তে হবে না।যেন যাপনের দৈনন্দিন সব সমস্যা বাজার-বিজ্ঞাপন-পণ্য চিহ্নিত করে ফেলেছে।এই ত্রয়ীর সূচনায় আবেদন, মাঝপর্বে ক্রয়, পরিশেষে অতৃপ্তি এবং এক অন্তহীন চাহিদার হাতছানি।
এ এক অদ্ভুত খেলা।বস্তুত এটাই কুশীলবদের অনন্ত ফাঁদ। বাজারসৃষ্ট সমস্যা অফুরন্ত, সমাধানও অশেষ। একটিতে সাফল্য লাভ করলেই অন্যটির দিকে ধাবিত হবে মন। এই সূত্রে, অননুমেয় সূক্ষ্মতায় আদতে চির অতৃপ্তি বৃহত্তর সমাজকে পেয়ে বসছে। মানুষ ক্রমে ভুলে যাচ্ছে (তথা বাধ্য করা হচ্ছে) যে, বাজারসৃষ্ট আদর্শ লক্ষ্যে পৌঁছানো মঙ্গলগ্রহে মানুষ পৌঁছনোর চেয়েও দুরূহ। এর ফলে সমাজের সঙ্গী হচ্ছে এক গভীর অনিশ্চয়তা। সমাজকে এভাবে বাজারের অনন্ত ফাঁদে ভুলিয়ে রাখতে পারলে রাজনীতির কুশীলবদের কতটা সুবিধা হয়, তা সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয়। কিন্তু হয় তো বটেই। পুরুষকে যদি তার পৌরুষ নিয়ে মাতিয়ে রাখা যায়, নারীকে মাতিয়ে রাখা যায় সৌন্দর্য আর সাহসিকতার অনুপম মিশ্রণে, তবে কে আর সমাজ-রাজনীতির পঙ্ক খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। অতি ব্যবহারের ক্রিকেটের মাঠ কিংবা রুপোলি পর্দার বিনোদনের আর্তিও নিরস হয়ে পড়ছে। অত:কিম, সমাজকে পণ্য-সংস্কৃতিতে মাতিয়ে রেখে পণ্যায়নের হীনম্মন্যতায় ডুবিয়ে রেখে, মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিয়ে রাখলে বাকি কর্ম ধর্ম এবং দেব-দেবীর মহিমায় সম্পন্ন হয়ে যাবে।মানুষকেই এই ফাঁদ থেকে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজতে হবে।