অর্থনীতির ফাঁপাতন্ত্র!!
প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ত্রী ও তার পারিষদেরা নিয়মিতভাবে দাবি করে চলেছেন যে,২০২৯ সালের আগেই জার্মানিকে টপকে ভারতের অর্থনীতি আড়ে-বহরে হয়ে উঠবে চতুর্থ বৃহত্তম, অর্থাৎ আমেরিকা, চিন এবং ব্রিটেনের পরেই। কিন্তু মাথাপিছু আয়?সেখানে আমাদের অবস্থায় কোথায়? একজন আমেরিকান গড়ে বছরে যা আয় করেন, তার চার ভাগের এক ভাগ আয় করতে একজন ভারতীয়ের আরও পঁচাত্তর বছর সময় লাগবে!
না,বিরোধীদের অভিযোগ নয়।এই তথ্য সামনে এসেছে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্টে।বিশ্ব ব্যাঙ্কের আশঙ্কা এই যে, স্বাধীনতার পর ভারতের বার্ষিক জিডিপি দ্রুত বাড়লেও বর্তমানে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে আমেরিকার বার্ষিক জিডিপির এক- চতুর্থাংশ ছুঁতেই আমাদের কয়েক দশক পেরিয়ে যাবে। অত:কিম উপায়?বিশ্ব ব্যাঙ্কের দাওয়াই, ব্যক্তি ধরে আয় বাড়ালে হবে না। গোটা দেশের মানুষের আয় বাড়াতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের উপর দুর্মূল্য বাজারের বিরূপ প্রভাব যে এখন দেশের অর্থনীতির সামনে জ্বলজ্যান্ত শিরঃপীড়া, এই সরল সত্যটি বুঝতে অর্থশাস্ত্রী হতে হয় না।
প্রতি বছরই বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের আয়ের ভিত্তিতে এই তালিকা প্রস্তুত করে বিশ্ব ব্যাঙ্ক।গত আঠারো বছর ধরে তালিকায় ভারতের অবস্থান ন যযৌ ন তস্থৌ:।একই অবস্থানে বিরাজমান নয়াদিল্লী।
মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ইন্দোনেশিয়ার থেকেও আমরা পিছিয়ে।ভারতের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্টে আরও একবার এই নির্মম তথ্যই সামনে এসেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪. দ্য মিডল ইনকাম ট্র্যাপ’ শীর্ষক রিপোর্ট বলছে, ভারতের মতো দেশগুলির অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর পথে মূল বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘মাঝারি আয়ের ফাঁদ’।আমেরিকার মাথাপিছু বার্ষিক ডিজিপির ১০ শতাংশের আয়তন প্রায় ৮০০০ ডলার।বিশ্ব ব্যাঙ্ক বলছে, যে সব দেশের মানুষ বছরে ৮০০০ ডলার রোজগার করেন, সেই সব দেশ বিশ্ব ব্যাঙ্কের মাপকাঠিতে মাঝারি আয়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ের আওতায় পড়ে।বিশ্ব ব্যাঙ্কের সদ্য প্রকাশিত তালিকায় ২০২৪-২৫ সালে ভারত বিরাজ করছে তৃতীয় পর্যায়ে, নিম্ন-মধ্য আয়সম্পন্ন দেশ হিসেবে। ২০০৬ সাল থেকে তি ভারতের এই অবস্থান একই জায়গায় দণ্ডায়মাণ।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের মাপকাঠিতে ভারতের মতো নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশও এই তৃতীয় ধাপেই রয়েছে।নিম্ন-মধ্য আয়সম্পন্ন শ্রীলঙ্কাও।আয়ের নিরিখে ভারত এখনও তৃতীয় স্থান থেকে নিজেদের তুলে আনতে ব্যর্থ।অথচ কেন্দ্রের সরকার নিয়মিত দাবি করে চলেছে, আগামী ছয় বছরের মধ্যেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে ভারত।হয়তো হবে এবং সেটি হবে বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জাতীয় আয়ের স্বাভাবিক প্রবণতায়।এর মধ্যে তেমন বাহাদুরি নেই, বরং সত্য এই যে, সেই তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির শরিক হতে পারবেন মাত্র ১০ কোটি মানুষ! কারণ ১৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ১০ কোটি লোকের বার্ষিক আয় আমেরিকার নাগরিকের সমান।
বাকি থাকলো চিনের সঙ্গে তুলনা।বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, নবুইয়ের দশকে চিন ভারতের মতোই নিম্ন আয়ের দেশ ছিল।কিন্তু এখন ভারতকে টপকে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে তারা।তবে মধ্য আয়ের দেশ হতে চিনের লাগবে এখনও দশ বছর। এমনকি ইন্দোনেশিয়াও ভারতের পাঁচ বছর আগে সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে বলে বিশ্ব ব্যাঙ্কের অনুমান।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের মাপকাঠি অনুযায়ী যে দেশের প্রত্যেক মানুষ বছরে ৮০০০ ডলার রোজগার করেন,সেই দেশ মাঝারি আয়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ে পড়ে।বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ মানুষই এই মাঝারি আয়ের তালিকাভুক্ত।বিশ্ব ব্যাঙ্কের থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে মাঝারি আয়ের দেশের সংখ্যা ছিল ১০৮।অর্থাৎ এই দেশগুলি মিলিয়ে মোট যে ৬০০ কোটি মানুষ বাস করেন, তাদের সকলেরই মাথাপিছু বার্ষিক জিডিপি ১,১৩৬ থেকে ১৩,৮৩৫ ডলার।
তাহলে আমাদের মাথাপিছু আয়ে একটা ন্যূনতম ভারসাম্যে জায়গা কী করে তৈরি হবে?অর্থশাস্ত্রীরা বলেন, সামাজিক বিশ্বাস এবং ‘সেন্স অব বিলঙ্গিং’।অর্থাৎ এই বোধ, যে সমাজটায় আমি আছি, আমিও তার অংশ অর্থনীতির স্বাস্থ্যের পক্ষে এই দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা গোটা পৃথিবীর এক বিপুল পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, যে সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস বেশি, সেখানে আর্থিক বৃদ্ধির হারও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশি।অন্য একটি গবেষণার ফল আমাদের জানিয়েছে, আফ্রিকার দেশগুলিতে যদি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলির মতো পারস্পরিক সামাজিক বিশ্বাস থাকত, তবে সেখানে মাথাপিছু জিডিপি ছয় গুণ বেশি হত।উন্নতির প্রশ্নে এই তত্ত্ব যেমন একটি সংস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, একইভাবে দেশের ক্ষেত্রেও। অন্যথা হলে যা হয়, তা হলো অর্থনীতির ফাঁপাতন্ত্র।
.