অশনিসংকেত।

 অশনিসংকেত।
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ভোট মানেই রাজনৈতিক লড়াই, তিক্ততা এসব থাকবেই। ভোট মানেই মারামারি, বোমাবাজি, সংঘর্ষ, রক্তারক্তি এসব নতুন কিছু নয়। তামিলনাড়ুতে একটা সময় ছিল যখন জয়ললিতা- করুণানিধি সম্পর্ক ছিল আদায় কাঁচকলায়। ঠিক একইভাবে উত্তর প্রদেশে মুলায়েম-অখিলেশের সঙ্গে বিজেপির কল্যাণ সিং কিংবা মায়াবতীদের সম্পর্কও অনেকটা সাপে নেউলের মতো। রাজস্থানে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে সম্পর্কটা যেরকম। পাঞ্জাবে আকালি ও -কংগ্রেসের মধ্যেও সম্পর্কটা ঠিক একইরকম। সম্পর্ক ভালো নেই অন্ধ্রে আগেকার তেলেগু দেশম আর কংগ্রেসের মধ্যে।হালে ওয়াইএসআর (জগনমোহন রেড্ডি) কংগ্রেস বনাম কংগ্রেস দলের রসায়নটা আরও তিক্ত। বিহারের কথা যত কম বলা যায়, ততটাই যেন ভালো। আরজেডির লালু বনাম জেডিইউর নীতীশের লড়াই মোটামুটি গোটা দেশের মানুষেরই বেশ ভালো জানা। রাজ্যে রাজ্যে প্রতিপক্ষ রাজনীতির খেলোয়াড়েরা কেউই কাউকে কখনও ভোটের ময়দানে এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দেবেন, এমনটা মনে করাই ভুল। সেই দিনগুলোকে পেছনে ফেলে উত্তরপ্রদেশ কিংবা বিহারের মতো রাজ্যগুলো নিজেদের বদলে নিয়েছে অনেকদিন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, গোটা দেশেই ভোটের রাজনীতিতে সব দলই এখন রত্নাকর দস্যু থেকে বাল্মীকি হয়ে গেছে। আসলে ভোটের লড়াই এখন ভোটের দিন হয় না। ভোট ঘোষণার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন কৌশলে, ছলাকলায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয় নির্বাচনকে প্রহসনাত্মক করার লক্ষ্যে। কিন্তু ভোটের ময়দানে পশ্চিমবঙ্গ আছে পশ্চিমবঙ্গতেই। পঞ্চায়েত কিংবা পুরসভা থেকে শুরু করে লোকসভার ভোট পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনেই পশ্চিমবঙ্গের ছবি প্রায় এক। শুধু একা পশ্চিমবঙ্গের দিকে আঙুল তুলে লাভ নেই। পূর্বোত্তরে আমাদের ছোট প্রান্তিক রাজ্য ত্রিপুরাতেও নির্বাচন নিয়ে অশান্তির ভুরি ভুরি প্রমাণ সাম্প্রতিক অতীতে রয়ে গেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি নির্বাচনের নামে বল্গাহীন সন্ত্রাসের যে তুর্কি নাচ চলে আসছে তা বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। বরং যত দিন যাচ্ছে, ততই ভোটে হিংসার ঘটনা বেড়েই যাচ্ছে। এটা ঘটনা যে,গোটা দেশেই নির্বাচনি ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ এবং যথাসম্ভব নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে টি এন সেশন, জেএম লিংডো এবং টিএস কৃষ্ণমূর্তির মতো দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারদের ভূমিকা – অবিসংবাদিত। বিশেষ করে সেশনের হাত ধরেই দেশের নির্বাচনি ব্যবহার যে আমূল সংস্কার ও পরিবর্তন করা হয়েছে, তার ফলেই ভোটে দুর্নীতি। প্রহসন, বাহুবলীদের দৌরাত্ম্য, রাজনীতির ক্ষমতাবানদের দাপাদাপি, কালো টাকার ব্যবহার প্রায় অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। এর আগেও নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো, মোতায়েন, হিংসা রুখতে সর্বোচ্চ কড়া ব্যবস্থা সবই চালু করা হয়েছিল তার সময় থেকেই। পরবর্তী সময়ে এই কড়াকড়ি আরও বেড়েছে এবং কমিশনের বেঁধে দেওয়া নিয়মের বাইরে কোনও পদক্ষেপ নিতে দল, প্রার্থী এবং নেতাদের এখন কয়েকবার ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে স্বায়ত্তশাসিত বা আঞ্চলিক সংস্থার নির্বাচনের দায়িত্ব যেহেতু জাতীয় নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ারে থাকে না। তার সুযোগ নিয়েই শাসক শক্তি দাদাগিরির সবগুলো পথই বেছে নেয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি এবং রাজনীতি আর সব রাজ্যের চেয়ে আলাদা ও ব্যতিক্রমী – সেটা মাথায় রেখেই বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসা ও হানাহানি নতুন কোনও বিষয় নয়। সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলনকে ঘিরে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের হাত ধরে যে হিংসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছিল সেটাই কালক্রমে বামেদের হাত ধরে আরও ফুলে ফলে পল্লবিত হয়েছে।শুধু প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির মধ্যেই এই লড়াই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বামেদের ৩৪ বছরে সিপিএম বনাম আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক, সিপিআই দলের ঝামেলা ও রক্তারক্তি তাকে আরও বেগবান করেছে।সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বঙ্গে ৭০ দশকে যে রক্তঝরা রাজনীতির সূচনা করেছিলেন প্রতিপক্ষ দমনের নামে নকশাল বাড়ি আন্দোলনের মাধ্যমে, পরবর্তীকালে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বাম রাজনীতিতেই হোক, কিংবা মমতা ব্যানার্জীর হালের রাজনীতিতে – সর্বত্রই সেই বীভৎসতা আরও প্রকট হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল এই রাজনীতির জন্য দায়ী কে?গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে জড়িয়ে, মানুষের গণতন্ত্রকে ভোটের ময়দানে ; যেভাবে হরণ করার ঘটনা বিগত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গে ঘটে চলেছে তার কি কোনওদিন নিরসন হবে না? আসলে ঘটনা হলো, সব শাসকই মুখে উন্নয়নের কথা বললেও শাসকের চেতনায় উন্নয়ন বলে বাস্তবে কোনও শব্দ থাকে না। যেটা থাকে সেটা হলো ক্ষমতার রাজনীতি। তাই কর্মসংস্থানহীন, চাকরিহীন যুবসমাজকে পেট চালাতে হলে শাসকের পেছনে থাকতে হবে, সেটা যেমন যৌবন জেনে গেছে। তেমনি বাহুবলীরা শাসকের সঙ্গে থেকে যা কামাই করেছে, সেই কামাইকে আগামীদিনে নিরাপত্তা দিতে কখনও তারা শাসককে, কখনও বিরোধীকে শক্তির ভারসাম্য বিচার করে সমর্থন জানাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ব্যবসা, লোন কিংবা সরকারী প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার দুর্বার আকর্ষণ। এভাবেই বেনিয়ম ও সন্ত্রাসে ভরপুর নির্বাচনে একপক্ষ শাসককে ক্ষমতায় না আনতে পারলে নিজের রোজগারে টান পড়বে ভেবে প্রাণপণে লড়াইয়ে নামে, তেমনি প্রতিপক্ষ শিবিরেও এই ভাবনা জন্ম নেয় শাসককে সরাতে না পারলে তার রোজগারের ব্যবস্থাটা হবে না। তাই সেই পক্ষও পাল্টা মরিয়া হয়ে হিংসায় জড়িয়ে যায়। এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর উদগ্র ক্ষুধা গণতন্ত্রকে যে কঠিন সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ভয় জয় করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.