অশুভ সঙ্কেত!!
আরও একটি যুদ্ধের দামামার অশনিসঙ্কেতের মধ্যে দিয়ে আআম আমরা বাংলা নতুন বছরে প্রবেশ করলাম।এমন সময় এটি প্রতীয়মান হয়েছে, ভারতের একশো চল্লিশ কোটি মানুষের দুয়ারে যখন কড়া নাড়ছে এক বিরাট নির্বাচন। পয়লা বৈশাখে ইজরায়েলে হামলা করেছে ইরান।যুযুধান দুই দেশের সঙ্গেই আমাদের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করেই ইরান ভারতকে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে চলেছে।ইরান থেকে আমরা প্রায় চাহিদার চল্লিশ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আমদানি করি।ইরানের চাবাহার বন্দরটি আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করে এবং ভারতের জন্য ওই বন্দরের গুরুত্ব আরও বেশি কারণ পাকিস্তান ভারতীয় পণ্যকে স্থল পরিবহণের অনুমতি দেয় না। পাশাপাশি, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের চলমান সন্ত্রাস, সেখানে সংখ্যালঘুদের প্রতি তালিবানের বৈরী আচরণে অনেক দিন ধরে নয়াদিল্লীর মতোই উদ্বিগ্ন তেহরান।ভারত থেকে চার হাজারের বেশি শ্রমিক ইরানে কর্মরত। আবার ইজরায়েলে কর্মরত প্রায় আটানব্বই হাজার ভারতীয়। ভারত-ইজরায়েলের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে পশ্চিম এশিয়ায় এমন সংঘাত, বিশেষত নির্বাচনের ভরা মরশুমে সমধিক উদ্বেগের।ইজরায়েল ও ইরান দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর। এখন ইজরায়েল পাল্টা ইরানে যুদ্ধ শুরু করলে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বাড়তে বাধ্য। পশ্চিম এশিয়ায় এই দুই দেশের স্বার্থ শুধু তেল ও শ্রম রপ্তানির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আরব মুলুকের রাষ্ট্রগুলিও ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অংশীদার, ফলে আশঙ্কার কথা এই যে, সংঘাত বৃহত্তর রূপ পরিগ্রহ করতেই পারে।
এমনিতেই পৃথিবীর দুটি প্রান্তে বর্তমানে চলমান দুটি প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। মুখে নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হলেও কখনও লুকিয়ে, কখনও প্রকাশ্যে প্রথম সারির সমস্ত দেশ অস্ত্রের আয়োজন বাড়িয়ে চলেছে।জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে প্রতি বছর বাজেট বরাদ্দ বাড়ছে প্রতিরক্ষা খাতে।সম্ভব হলে যেন সাগর সিঞ্চন করেও তারা খুঁজে বার করতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাণঘাতী অস্ত্রের ভাণ্ডার।
আশ্চর্যের এই যে, পৃথিবীর কাছে একটা নয়, দুটো বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস আছে। পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের ভয়াবহতা এবং তার ফলাফল জানা সত্ত্বেও, পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে পরিচয় দেওয়াটা ক্রমে শ্লাঘার বিষয় হয়ে উঠেছে। শান্তিকামী মানুষের কাছে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিগুলি ক্রমে নিছক কাগজের অপচয় হয়ে
উঠেছে।
যুদ্ধে কী হয়?প্রাথমিক ভাবে, প্রাণক্ষয় হয়। যারা যুদ্ধে যায়, সেনা, তারা আসলে নাগরিক, মানুষের ঘরের সন্তান। তারাই সর্বাগ্রে মারা পড়ে।যুদ্ধ ঘোরতর হলে, রাষ্ট্রের আহ্বানে ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবে যুদ্ধে যেতে হয়।যদিও জাতীয়তাবাদ আজ আর শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় সীমান্ত দ্বারা নির্ধারিত নয়, তবুও, যুদ্ধের সময় রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের উগ্রতা বেড়ে যায়।আর সেটা যে কোনও রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অথবা অন্য কোনও রকম জটিল সঙ্কট মোচনে হয়ে উঠে ক্ষমতার প্রত্যাবর্তনের সহজ পন্থা। যদিও সকলেই জানে, যুদ্ধের পরেই আসে অর্থাভাব, অনাহার, মন্দা এমনকি মহামারির মতো সঙ্কট।
যুদ্ধের সময় জীবনহানির সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি যা হয়, তা হলো মানুষের সম্মানের হানি।এখন সব দেশের হাতেই রয়েছে শক্তিশালী সব ক্ষেপণাস্ত্র, যার দাপটে মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় একটি গোটা শহর। প্রাণনাশের পাশাপাশি বহু মানুষ গৃহহীন হয়। দূর-দূরান্তে বসেই বোতাম টিমে শয়ে শয়ে মানুষকে পরিণত করা যায় উদ্বাস্তুতে।তখন সম্ভ্রমের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও হারাতে হয় এই সর্বস্বান্ত মানুষগুলিকে।শুধু তাই নয়, যুদ্ধের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে নারী ও শিশুদের উপরে। তাদের উপরেই লাঞ্ছনার মাত্রা সর্বাধিক হয়। মৃত্যু ও স্থাবর সম্পত্তির সঙ্গে ক্ষতি হয় প্রকৃতিরও। প্রভাবিত হয় বৈশ্বিক অর্থনীতিও। যুদ্ধের আঁচ স্থল থেকে জলেও ছড়ালে ব্যাহত হয় আমদানি-রপ্তানির স্বাভাবিক গতিবিধি।ঘুরপথে চলাফেরার কারণে স্বাভাবিকভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে জ্বালানি- দাম বাড়ে সব কিছুর। এর প্রভাব পড়ে সব দেশেই, তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। এখন একটি যুদ্ধের অর্থ, যুদ্ধের সমান্তরালে জেগে উঠা আরও যুদ্ধক্ষেত্র। পৃথিবীর সব প্রান্তের মানবাধিকারের উপর
আঘাত।তাই যুদ্ধের দামামার চেয়ে অশুভ সঙ্কেত আর কিছু নেই।