অসঙ্গতির আয়োগ!!

 অসঙ্গতির আয়োগ!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অনলাইন প্রতিনিধি :- তৃতীয়বার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর শনিবার সকালে রাইসিনা হিলের রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পৌরোহিত্যে নীতি আয়োগের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। নীতি আয়োগ ছিল দেশকে আমূল বদলে দেওয়ার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোকে সঠিক আর্থিক নীতি তৈরিতে সাহায্য করতে এবং সেখানে নতুন চিন্তা ভাবনার জোগান দেওয়ার জন্য মূলত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসাবেই এই প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তোলা হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি শামিল করা হয়েছিল সমস্ত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুরোনো যোজনা কমিশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ছিল, দিল্লীতে বসে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তি দেশের প্রত্যন্ত এলাকার উন্নয়নের জন্য নীতি তৈরি করতেন। আর বছর বছর সেই নীতি চাপিয়ে দেওয়া হতো রাজ্যগুলোর উপর। যা নিয়ে রাজ্যগুলোর মধ্যে অসন্তোষ বরাবরই ছিল প্রকট। বিভিন্ন সময়ে যোজনা কমিশনের কাজকর্ম নিয়ে রাজ্যগুলোর তরফে অভিযোগের পরিমাণ বেড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, যে নীতি কাশ্মীরের জন্য প্রযোজ্য, সেই একই নীতি কী করে কেরালার জন্য লাগু করা হয়? সে কারণেই যোজনা কমিশন নিয়ে বিগত দিনগুলোতে অভিযোগ আপত্তির শেষ ছিল না প্রাদেশিক রাজ্যগুলোর তরফে। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পরের বছ ২০১৫তে যোজনা কমিশন অবলুপ্ত করে নীতি আয়োগের ঘোষণ দেন। মোদি ট্যুইট করে জানিয়েছিলেন- ‘সব পায়ের জন্য একই মাপো জুতোর নীতিকে বিদায় দিলাম। ভারতের বহুত্ব ও বৈচিত্র মেনে এখানে কাজ করবে ‘নীতি আয়োগ’। কেন্দ্রের মোদি সরকারের বক্তব্য ছিল, নবগঠিত নীতি আয়োগের প্রধান লক্ষ্য হবে আর্থিক নীতি তৈরির ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ। যে সমস্ত রাজ্যে উন্নয়নের সুবিধা সঠিক মাত্রায় পৌঁছায়নি, সেখানে বিশেষ নজর দিয়ে নীতি আয়োগ উন্নয়নের সুষম বন্টনকে নিশ্চিত করবে। কিন্তু প্রধান লক্ষ্য হবে আর্থিক নীতি তৈরির ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ। যে সমস্ত রাজ্যে উন্নয়নের সুবিধা সঠিক মাত্রায় পৌঁছায়নি, সেখানে বিশেষ নজর দিয়ে নীতি আয়োগ উন্নয়নের সুষম বন্টনকে নিশ্চিত করবে। কিন্তু নীতি আয়োগ গঠিত হওয়ার এখনও ১০ বছর পূরণ হয়নি।


অথচ কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর হাজারো প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও মাত্র আট- নয় বছরের মধ্যেই নীতি আয়োগ নিয়ে তাবড় বিরোধী দলগুলোর তরফে প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, মাত্র বিভ এই অল্প সময়ের মধ্যেই নীতি আয়োগের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটতে শুরু করেছে বিরোধীদের এবং নীতি আয়োগের পরিবর্তে পুনরায় যোজনা আয়োগকে ফিরিয়ে আনার দাবি উঠতে শুরু করেছে। শুরু থেকেই নীতি আয়োগের ভূমিকা, এর কাজকর্মের ধরন, রাজ্যের জন্য বরাদ্দ নির্ধারণে এতকাল কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সমন্বয় রক্ষার যে কাজটি করত যোজনা কমিশন, বর্তমানে সেই শূন্যতায় নীতি আয়োগের ভূমিকাহীনতা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মাত্র দিন পাঁচেক আগেই কেন্দ্রীয় বাজেটে বিরোধী রাজ্যগুলোকে আর্থিকভাবে বঞ্চনা করার বিরুদ্ধে একসুরে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন বিজেপিবিরোধী ইন্ডিয়া জোটের নেতারা। এরই প্রতিবাদে কংগ্রেসশাসিত তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী-কর্ণাটকের সিদ্ধারামাইয়া, তেলেঙ্গানার রেবন্ত রেড্ডি, হিমাচল প্রদেশের সুখবন্ত সিং সুখু শনিবারের নীতি আয়োগের বৈঠক বয়কট করেছিলেন। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তথা ডিএমকে প্রধান এমকে স্ট্যালিন, আম আদমি পার্টির পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান এবং কেরালার সিপিএম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও একই কারণে নীতি আয়োগের বৈঠকে না যাওয়ার ঘোষণা দেন। বিস্ময়করভাবে বিহারের নীতীশও ছিলেন না বৈঠকে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন এবং তিনি বৈঠকে যাবেন এবং এই বঞ্চনা নিয়ে সরব হবেন সোরেন গরহাজির থাকলেও বৈঠকে গিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু মমতার সেই বৈঠকে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। অভিযোগ, নীতি আয়োগের বৈঠকে মমতাকে ৫ মিনিটের বেশি বলতে দেওয়া হয়নি। মাঝপথেই মমতার মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই ওয়াকআউট করে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে এলেন মমতা। অতীতে কংগ্রেস সাংস রাহুল গান্ধী একাধিকবার লোকসভায় তার মাইক বন্ধের অভিযোগ তুলেছেন। এবার নীতি আয়োগের বৈঠকে একজন মুখ্যমন্ত্রীর মাই বন্ধ করে দেওয়ার অর্থাৎ কণ্ঠরোধ করার অভিযোগ উঠলো। যদি মমতার এই অভিযোগ মানতে নারাজ কেন্দ্র। কিন্তু এটা ঘটন একদিকে বাজেটে বিরোধী সরকার পরিচালিত রাজ্যগুলোর প্রতি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণের ঘটনা এবং পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রীয়কাঠামোর প্রাদেশিক ব্যবস্থার কণ্ঠরোধ ও অধিকার খর্বের মতো অভিযোগ কোনও ভাবেই সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাম্য নয়। গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের আড়ালে যদিও ইন্ডিয়া জোটকে এড়িয়ে নীতি আয়োগের বৈঠকে মমতার যোগদান এবং ওয়াকআউটের ঘটনার পেছনে অনেকেই সাজানো চিত্রনাট্যের গন্ধ পাচ্ছেন। কিন্তু ঘটনা যাই হোক, গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আড়ালে এই ধরনের আচরণ কার্যত স্বৈরাচারকেই আহ্বান করার শামিল। এতে রাজ্যগুলোর মধ্যে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তেমনি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আর্থিক ও রাজনৈতিক আচরণ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই নড়বড়ে করে দেবে। রাজ্যগুলোর মধ্যে সমবন্টন ও আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য নীতি আয়োগ গড়ার সময়, পা মেপে সকলের আলাদা জুতো তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া মোদি এখন মর্জিমাফিক জুতো তৈরি করে রাজ্যগুলোর মধ্যে বিলি করতে তৎপর হওয়ায় এবং এর বিরুদ্ধে কথা বললেই মাইক বন্ধ করে দেওয়ার যে অপকৌশল অবলম্বন করেছেন, তা যে হিতে বিপরীত পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে, কেন্দ্রের মনসবদাররা যত তাড়াতাড়ি সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন, ততই তাদের মঙ্গল।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.