অ্যাডিনো ভাইরাসঃ দুবছরের নিচের শিশুদের সুরক্ষায় বাড়তি সতর্কতা নিন

 অ্যাডিনো ভাইরাসঃ দুবছরের নিচের শিশুদের সুরক্ষায় বাড়তি সতর্কতা নিন
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অ্যাডিনো ভাইরাস কী ? এ টা এক ধরনের ডিএনএ ভাইরাস। যেমন কোভিড আরএনএ ভাইরাস ছিল, অ্যাডিনো হল ডিএনএ ভাইরাস। এই ভাইরাসটা খুব একটা নতুন নয়। অন্যান্য রেসপিরেটরি ভাইরাসের মতোই সারফেস কন্টাক্ট, হাঁচি, কাশি দিয়ে একজনের থেকে অন্যজনের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া হতে পারে।
নিউমোনিয়া এবং অ্যাডিনো ভাইরাসের মধ্যে তফাৎ কোথায় ?
নিউমোনিয়া হওয়ার অনেক কারণ থাকে। নিউমোনিয়া সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণ। তবে ছত্রাকঘটিতও (ফাঙ্গাল) হতে পারে। বাচ্চাদের যে নিউমোনিয়া হয় সেটা সাধারণত ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া। মূলত স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি ব্যাকটেরিয়া এই রোগের মূল কারণ। আক্রান্তের হাঁচি-কাশি মারফৎ জীবাণু বাতাসে মেশে। তারপরে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শিশুর শ্বাসনালি ও ফুসফুসে গিয়ে বাসা বাঁধে। আর সেখানেই বংশবৃদ্ধি করতে করতে ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোয় সংক্রমণ হয়। আগে ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি থেকেও নিউমোনিয়া হতো। ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া আমরা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ট্রিটমেন্ট করি।ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়াগুলো মাঝে কমেছিল কারণ বাচ্চারা নিয়মিত ভ্যাক্সিন নিত। এ ছাড়াও ভাইরাল নিউমোনিয়ার মধ্যে রয়েছে আরএসভি, অ্যাডিনো ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, কোভিড ভাইরাস, রাইনো ভাইরাস। এগুলির সংক্রমণেও নিউমোনিয়া হতে পারে। অন্যদিকে, ব্যাকটেরিয়াঘটিত নিউমোনিয়ার মধ্যে রয়েছে স্ট্যাফাইলোকক্কাস, এইচ ইনফ্লুয়েঞ্জি, টিউবারকোলোসিস (টিবি)। এছাড়াও ফাঙ্গাল নিউমোনিয়া হয়। তবে এই নিউমোনিয়া সাধারণত খুব কম হয়। এমনি উপসর্গ দেখে বোঝা খুব মুশকিল কিন্তু এক্সরেতে বোঝা যায় ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া একদিকের লাঙ বা ফুসফুসকে এফেক্ট করে কিন্তু ভাইরাল নিউমোনিয়া দু’দিকের ফুসফুসকেই এফেক্ট করে।
অ্যাডিনো ভাইরাসের উপসর্গ? অন্যান্য ভাইরাল নিউমোনিয়া যেমন সর্দি, কাশি, হাঁচি এগুলো যখন হয় তখন বাড়ির অনেক সদস্যই একসঙ্গে ভুগতে থাকে। ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে অনেক মানুষ একসঙ্গে ভোগে না। ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে তাপমাত্রা একটু বেশি থাকে। যদিও অ্যাডিনো ভাইরাসের ক্ষেত্রে জ্বর খুব বেশি আসে। এই জ্বর প্যারাসিটামল দিয়েও অনেক সময় কমানো যাচ্ছে না। আরও যাদের মধ্যে অ্যাডিনো ভাইরাস ধরা পড়ছে তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই চোখে কনজেনটিভাইটিস পাওয়া যাচ্ছে। তবে একশো শতাংশ ক্ষেত্রেই যে পাওয়া যাচ্ছে তা নয়। কিন্তু কনজেনটিভাইটিস, জ্বর এগুলো একসঙ্গেই হতে পারে। এভাবেই একটা ধারণা করা যেতে পারে। বায়োফার টেস্ট করালেও ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া নাকি অ্যাডিনোভাইরাস তা ধরা পড়ে। এটা একটু ব্যায়বহুল টেস্ট। দেশের সর্বত্র পাওয়া যায় না। সাধারণত আমরা রুটিন ব্লাড টেস্ট, এক্সরে এবং ক্লিনিক্যাল ফিচার দিয়েই বিষয়টা ধরার চেষ্টা করি।তার মানে সব সর্দি, কাশি, জ্বরই অ্যাডিনো ভাইরাস নয়? সব সর্দি, কাশি, জ্বরই অ্যাডিনো ভাইরাস নয়। অ্যাডিনো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সবারই যে খুব খারাপ হচ্ছে তাও নয়। অ্যাডিনো ভাইরাসের প্রায় ১০০ টি স্ট্রেন রয়েছে। এর মধ্যে যে কোনও ট্স্ট্রেনে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। তার মধ্যে ৭ নম্বর স্ট্রেনটি বেশি মারাত্মক।
কী ধরনের সতর্কতা মেনে চলা
উচিত ? যেসব শিশু এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে তাদের বেশিরভাগেরই বয়স হচ্ছে দুই বছরের নিচে। এদের বডি ইমিউনিটি কম। যাদের কোমবিড ফ্যাক্টর রয়েছে। কোনও একটা শিশু হয়তো হার্টের রোগে আক্রান্ত, জন্মগত ভাবে তার হার্টে ত্রুটি আছে। নার্সারিতে যে সব শিশুকে অনেকদিন ধরে রেখে চিকিৎসা করা হয় কিংবা রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনে ভুগতে থাকা শিশু, লিউকোমিয়া পেশেন্ট বা অনেক দিন ধরে স্টেরয়েড নিচ্ছে, কিডনিগত কোনও রোগ আছে, এরকম শিশুদের পরিস্থিতি বেশি খারাপ হওয়ার চান্স থাকে। তাদেরকে কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।প্রিভেনশন বা প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। কারণ অ্যাডিনো ভাইরাসের কোনও ওষুধ নেই। কোভিডের সময় যে নিয়মবিধি মানতে বলা হয়েছিল এক্ষেত্রেও কিন্তু একই বিষয় বলা হয়েছে। হাত ধোয়া, স্যানিটাইজ করা, যারা মাস্ক পরতে পারে তাদের মাস্ক পরা। কিন্তু একটা বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন, ছোট ছোট শিশুরা তো ভিড়-ভাট্টায় খুব একটা যাচ্ছে না। তারা তো নিজেদের হাত নিজেরা ধুতে পারে না, মাস্কও তারা পরতে পারে না। তাদের বড়দের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বলব, বড়রা যারা বাইরে যাচ্ছেন তারা বাইরে থেকে এসেই ছোটদের কাছে যাবেন না। বাবা-মা অফিস থেকে ফিরলে ছোটরা তাদের কাছে দৌড়ে যাবেই। কিন্তু বড়দের সেটাকে একটু সংবেদনশীল হয়ে দেখতে
বাড়ির হয়তো একটু বড় শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে। তাদেরকে বোঝাতে হবে ছোট ভাই-বোনদেরকে স্কুল থেকে এসেই যাতে তারা না ধরে। পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন হয়ে তবেই যেন তারা ভাই-বোনদের কাছে যায়। অ্যাডিনো ভাইরাস কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্টুল দিয়েও ট্রান্সমিশন বা সংক্রমণ হয়ে থাকে। তাই স্টুল ডিসপোজার বা নিষ্পত্তিকরণ খুব ভাল ভাবে করতে হবে। যে কোনও কারণেই বাচ্চা যখন সর্দি-কাশিতে ভোগে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যথাযথ সময়ে যাওয়াটা কিন্তু জরুরি। যখন জ্বর তিন থেকে পাঁচদিনের বেশি থাকবে তখন ভাবতে হবে। অনেক সময় শিশু জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে, শ্বাসকষ্ট হয়। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, পাঁজরা ঢুকে যাওয়া, নাকের পাশের লতিগুলো যদি ফুলতে থাকে, বাচ্চা ঝিমিয়ে পড়ছে—এরকম কষ্ট হলে শিশুকে খুব তাড়াতাড়ি হসপিটালাইজড করতে হবে। শিশু যে পরিমাণ খাওয়া-দাওয়া করে তার চাইতে হয়তো তার খাওয়ার পরিমাণ কমে গেছে, এই দিকগুলো আপনার সন্তানের মধ্যে দেখা দিলেই তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এইসব বাচ্চাদের হাসপাতালে নিয়ে আসতে দেরি হলেই তারা খারাপ অবস্থার মধ্যে যেতে পারে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোন কোন দিকে বিশেষ ভাবে নজর রাখা প্রয়োজন ?হাসপাতালে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরে থাকা প্রয়োজনীয়। অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে আসা শিশুদের দ্রুত উপযুক্ত পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা হাসপাতালগুলোতে রাখা প্রয়োজন। অসুস্থ শিশুদের দ্রুত স্ক্রিনিং করা, চব্বিশ ঘণ্টা ফিভার ক্লিনিক খুলে রাখা দরকার হাসপাতালে। যে সব হাসপাতালে পিআইসিইউ নেই সেইসব হাসপাতালে শিশুকে ভর্তি না করাই ভাল। আবার, পিআইসিইউ যেসব হাসপাতালে আছে অথচ সেখানে হয়তো বেড নেই কিন্তু তবুও অসুস্থ যেসব শিশুদের আনা হচ্ছে তাদের আগে স্টেবিলাইজড করে তারপর অন্য জায়গায় পাঠানো উচিত। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে ফোন করে কোথাও পিআইসিইউ খালি আছে কিনা সেটা আগে জেনে তারপর শিশুকে পাঠাতে পারলে বেশি ভাল হয়। কারণ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরির ফলে শিশুটির শরীর আরও খারাপ হতে পারে। এর পাশাপাশি পেরেন্টিং কাউন্সিলিং করাটাও বিশেষ প্রয়োজন। এগুলো অবশ্যই হাসপাতালের দিক থেকে করা উচিত।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.