আক্রান্ত শহিদের স্ত্রী!!

 আক্রান্ত শহিদের স্ত্রী!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

বিয়ের ছয়দিনের মাথায়, মধুচন্দ্রিমা যাপনে গিয়ে চোখের সামনে জঙ্গিদের বুলেটে স্বামীকে হারানো স্ত্রীর বুকফাটা কান্না এ দেশ শোনেনি,উল্টে গত চারদিন ধরে তরুণী মেয়েটিকে ক্রমাগত হজম করে যেতে হচ্ছে নেটাগরিকদের একটি বড় অংশের কুৎসিত আক্রমণ। বীভৎসতায় তা হয়তো জঙ্গিদের নৃশংসতম আচরণের কাছে অকিঞ্চিৎকর,কিন্তু একজন নারীর, বিশেষত তিনি যেখানে জঙ্গিদের গুলীতে সদ্য শহিদ হওয়া নৌসেনা আধিকারিকের স্ত্রী, তার সম্ভ্রম, গরিমা, সামাজিক মর্যাদাকে একদল উগ্র ধর্মান্ধ মানুষ যখন ভূলুণ্ঠিত করতে মরিয়া হয়ে উঠে এবং ততোধিক আক্ষেপের, সরকার যখন সব কিছু দেখেও কার্যত মুখ বুজে বসে থাকে, তা অতিশয় দুর্ভাগ্যের।
হরিয়ানার কার্নালের বাসিন্দা ছাব্বিশ বছর বয়সি নৌসেনার লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়াল ও চব্বিশ বছর বয়সি গবেষিকা হিমাংশীর বিবাহ হয় গত ষোল এপ্রিল।মধুচন্দ্রিমায় তারা কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে গিয়েছিলেন।বাইশ এপ্রিল, বৈসরন উপত্যকায় জঙ্গিদের হাতে ছাব্বিশজনের সঙ্গে নিহত হন বিনয়। স্বামীর মৃতদেহের পাশে বরফের মতো শীতল হিমাংশীর হাঁটু মুড়ে বসে থাকার ছবি, স্বামীর কফিন ধরে বুকফাটা কান্নার দৃশ্য গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।পয়লা মে শহিদ বিনয়ের স্মৃতিতে আয়োজিত একটি রক্তদান শিবিরে হিমাংশী বলেন, আমার স্বামী হামলার শিকার হয়েছেন, এটা আমার পরিবার ও গোটা দেশবাসীর জন্যই দুঃখজনক।তবে দয়া করে এই হামলার জন্য পুরো মুসলিম সম্প্রদায় বা কাশ্মীরি জনগণকে দায়ী করবেন না। সাধারণ কাশ্মীরিরা আমাদের অনেক সহায়তা করেছেন, পাশে থেকেছেন। সেদিন সংবাদমাধ্যমের সামনে হিমাংশী আরও বলেন, আমি শান্তি চাই, হিংসা আর বিদ্বেষ নয়। আমি চাই, অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ধর্মীয় ও ভৌগোলিক পরিচয় দিয়ে কাউকে ছোট করা উচিত নয়। এই হামলা সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে করা হলেও, তা সমাজকে বিভক্ত করার চেষ্টা মাত্র। …. হাসপাতালে আমার স্বামীর চিকিৎসার সময়ে সাধারণ কাশ্মীরিরা রক্তদান করেছেন। পুলিশ, স্থানীয় মানুষ এগিয়ে এসেছেন।
তারাই আসল কাশ্মীর।আমি ও আমার পরিবার তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
এর অব্যবহিত পর থেকেই এক্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের নির্লজ্জ আক্রমণের শিকার হতে শুরু করেন হিমাংশী। চারদিন অতিক্রান্ত, একজন সদ্য স্বামীহারা মহিলাকে নেট মাধ্যমে ছাপার অযোগ্য ভাষায় অবারণ আক্রমণ এবং চরিত্রহনন চলছে। এমনকী হিমাংশীর প্রাপ্য পেনশন বন্ধের সওয়ালও চলছে। তবে তার চেয়েও আশ্চর্যের এ ব্যাপারে সরকারের নীরবতা,তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর নীরবতা।শহিদের স্ত্রীকে যারা এমন কদর্য আক্রমণ করছে, কোনও রাজ্যের পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।তিনদিনের মাথায় জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়ালজির মৃত্যুর পর যেভাবে তার স্ত্রীকে সমাজমাধ্যমে আক্রমণ করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ওই পর্যন্তই, সমাজমাধ্যমে শব্দের কষাঘাতে যারা একজন সদ্য স্বামীহারা তরুণীর সম্ভ্রমকে বেআব্রু করার চেষ্টা করেই চলেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও বার্তা দেয়নি মহিলা কমিশন। কোনও রাজ্যের পুলিশবাহিনীর শীর্ষকর্তাকেও এই মর্মে কোনও নির্দেশ দেয়নি যেন ট্রোলবাহিনীকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
কেন হিমাংশীর প্রতি উগ্র ধর্মান্ধদের এমন কদর্য আক্রমণ, আধুনিক ভারতে তার কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ দেশের দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্র যে রাজনৈতিক ন্যারেটিভ স্থাপন করতে চায়, হিমাংশীর কথা যে তার পরিপন্থী! হিমাংশী এমন কথা বলেছেন, যা সম্ভবত ক্ষমতার অন্তরের কথার বিপরীত। তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেণ্ডার প্রতিকূল। হিমাংশীর তিন-চার বাক্যের সরল বার্তা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বিদ্বেষের রাজনীতির বিপ্রতীপ। সর্বোপরি, প্রচারমাধ্যমের একাংশের উগ্র হিন্দুত্ব প্রচারে অতি সক্রিয়তার পিছনে বিভেদকামী রাজনীতির আনুকূল্য ও উৎসাহের দিকটিকে নম্র ভাষায় আঘাত করেছে হিমাংশীর কথা। ঘোষিত হিন্দুত্ববাদীদের বাইরেও হিন্দুদের বেশ বড় একটি অংশ যে এখনও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, মানবতায় বিশ্বাস করে, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে, তেমনই একজন হিমাংশী নরওয়াল। যার নববিবাহিত স্বামীকে ধর্মীয় হিন্দু পরিচয় জেনে জঙ্গিরা খুন করা সত্ত্বেও, যে নারী বলতে পারেন, এই হামলা সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে করা হলেও এর জন্য পুরো মুসলিম সম্প্রদায় বা কাশ্মীরি জনগণকে দায়ী করবেন না। এই নারীকে, শহিদের স্ত্রীকে যারা আক্রমণের নিশানা করেছেন তাদের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেল চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক সরকার, তাতে শহিদের আত্মা শান্তি পাবে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.