আজও পড়ন্ত বিকালে গ্রামে শোনা যায় খেজুর গাছ কাটার ঠুকঠাক শব্দ

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

প্রায় বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাওয়া খেজুরের রস ও রস থেকে উৎপাদিক নলেন গুড় বর্তমানের ডিজিটাল যুগেও রাজ্যের গ্রাম ও শহরে ব্যাপক চাহিদা আজও বিদ্যমান। বাঙালির রসনা তৃপ্তিতে প্রকৃতির দান প্রাকৃ খেজুরের রস এবং রস থেকে তৈরি সুস্বাদু নলেন গুড়ের এবং পাটালি তথা তক্তি গুড়ের জুড়ি আজও গুড় অদ্বিতীয়। অমরপুরের গ্রামাঞ্চলে আগেকার দিনের মতো ব্যাপক ভাবে না হলেও বর্তমানের ডিজিটাল যুগেও বিক্ষিপ্ত ভাবে খেজুর গাছের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। খেজুরের রস ও খেজুরের রস থেকে তৈরি অন্য সুস্বাদু মিষ্টি মধুর সুগন্ধি যুক্ত নলেন গুড়কে যাকে কেউ কেউ লালি কিংবা মরচে গুড় ও পাটালি কিংবা তক্তি গুড় বলে থাকেন সেই সুস্বাদু সুঘ্রান যুক্ত গুড় বর্তমানেও নিজের অস্তিত্বের জানান ভালো ভাবেই দিয়ে যাচ্ছে প্রতি বছর শীতের মরশুমে তথা পৌষ, মাঘ মাসে। বর্তমানে শীতের পিঠেপুলির মরশুমে গ্রামাঞ্চলে ঢেঁকি কিংবা গাইল ব্যবহারের শব্দ শোনা না গেলেও বর্তমান মরশুমের সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রাক্কালে চির পরিচিত খেজুর গাছ কাটার ঠুকঠাক শব্দ জানান দেয় শীতের সুস্বাদু খেজুরের রসের আগমনের। খেজুর গাছ কাটার মধ্যেও একধরনের শিল্প সত্তা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান নব প্রজন্মের অধিকাংশ কিশোর ও যুবরা জানেই না নলেন গুড় কি জিনিস, কিংবা নলেন গুড় কি কাজে ব্যবহৃত হয়। খেজুর গাছে খেজুর পেকে থাকলেও খাওয়ার কেউ নেই। আর খেজুর গাছের রসের হাঁড়ির ভেতরে পেঁপে গাছের ডালা ঢুকিয়ে রস চুরি করে খাওয়ার মজা কি জিনিস সেটা থেকেও বর্তমান প্রজন্মের ছেলে ছোকড়ারা বঞ্চিত থেকে গেছে।বাঙালির পৌষ মাস মানেই পিঠেপুলি খে আর সুগন্ধ ছড়ানো খেজুরের রসের মিষ্টান্ন আস্বাদন নেওয়ার মাস। গ্রামাঞ্চলে এই মরশুমে প্রায় প্রতি বাড়িতেই পিঠেপুলি, খেজুরের রসের কিংবা নলেন নগর গুড়ের মিষ্টান্ন তৈরি হয়ে থাকে। আজকাল শহরের ময়রার দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় প্রসিদ্ধ মিষ্টি গিয়ে বিক্রেতাদের দোকানে হরেক রকমের পিঠেপুলি বিক্রি হয়ে থাকে। যদিও দোকানের সেই পিঠেপুলির মধ্যে গ্রামে বিশুদ্ধ নলেন গুড়ের এবং বাড়ির মা ঠাকুরমার হাতের তৈরি মিষ্টান্ন ও পিঠেপুলির সেই স্বাদ গন্ধ কতটুকু থাকে তা জানা নেই। অমরপুরের গ্রামাঞ্চলে আজও খেজুর গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ওইসব খেজুর জানি গাছে আষাঢ়, শ্রাবণ মাসের বর্ষার মরশুমে থোকায় থোকায় সুস্বাদু হলদে রংয়ের খেজুর ধরে। আবার সেই খেজুর গাছই শীতের মরশুমে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিকে অথবা পৌষ মাসের শুরু থেকে মাঘ মাসের শীতের মরশুম পর্যন্ত সুস্বাসু খেজুরের রস দিয়ে থাকে প্রাকৃতিক ভাবেই। তবে খেজুর গাছ থেকে রস বের করানো থেকে রস সংগ্রহ এবং সেই রস থেকে নলেন গুড় ও পাটালি গুড় তৈরি করা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট “গাছি” কে (আমাদের গ্রামাঞ্চলে যিনি খেজুর গাছ কেটে সুস্বাদু খেজুরের রস বের করেন সেই ব্যক্তিকেই “গাছি” বলে সম্বোধন করা হয়)। গ্রামাঞ্চলের গাছিরা অন্যান্য পেশার পাশাপাশি পুরানো দিনের পারিবারিক
পেশা তথা ঠাকুরদার নিকট থেকে শেখা খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে নলেন গুড় তৈরির পেশাটাকেও আজও ধরে রেখেছেন। ওই পেশার সাথে যুক্তরা খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে প্রাচীন পদ্ধতিতে নলেন গুড়, পাটালি গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে সংসার প্রতিপালন করছেন। শখের বসে অমরপুর নগর পঞ্চায়েতের ষাটোর্ধ্ব নিরঞ্জন দাস এবছর পাঁচটি খেজুর গাছ কেটেছেন। নলেন গুড় তৈরির ঝক্কিতে না গিয়ে তিনি শুধু খেজুরের রসই বিক্রি করে দুপয়সার মুখ দেখেছেন বলে জানান। মালবাসা ও মৈলাক গ্রামের শম্ভু দেবনাথ, সুনীল দেবনাথ, শহিদ মিঞারাও খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ কার থেকে নলেন গুড়, তক্তি তৈরি করে এবং সেই গুড় বাজার জাত করে সংসার প্রতিপালন করে থাকেন। শহিদ মিঞা জানিয়েছেন, তিনি এবছর ত্রিশটি খেজুর গাছ কেটেছেন। ঘন কুয়াশা ও শীতের প্রকোপ যত বেশি হবে খেজুরের রসের আমদানির পরিমাণও ততটাই বেশি হবে। এবছর শীতের প্রকোপ বেশি হওয়ায় গাছ থেকে রসের আমদানির পরিমাণও বেশ ভালোই পাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট গাছিরা জানিয়েছেন।শহিদ মিঞা জানান,সংগ্রহ করা খেজুরের রস লাকড়ির চুলোয় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এবং নির্দিষ্ট পাত্রের মধ্যে জ্বাল দিয়ে ক্রমান্বয়ে নলেন গুড় কিংবা লালিগুড় তৈরি করেন। আর সাজ তৈরি করে কিংবা নির্দিষ্ট এছাড় ক্তিকেই পরিমাপ মতো গর্ত করে সেই গর্তগুলির উপর পরিষ্কার কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হয়।পরে লাকড়ির চুলোর উপরের পাত্র থেকে গরম গরম নলেন গুড় তথা লালি কর্মক গুড় ওই কাপড়ের বিছানো গর্তে কিংবা সাজে ঢেলে দেওয়া হয়।পরে সেই গুড়ের চাকা গুলিই ঠাণ্ডা হয়ে শক্ত হয়ে গেলেই তক্তি গুড় তথা পাটালি গুড়ে জিনিয় পরিণত হয়।মহকুমায় এবং মহকুমার বাহিরে অমরপুরের নলেন গুড়ের ও পাটালি গুড়ের বেশ চাহিদা রয়েছে।অমরপুর দৈনিক বাজারে গুড় উৎপাদক শম্ভু দেবনাথ নলেন গুড় এবং তক্তি গুড় দুটোই কেজি প্রতি তিনশ টাকা করে বিক্রি করছেন বলে জানিয়েছেন।ক্রেতারা লাইন দিয়ে সুস্বাদু খেজুরের রসের গুড় ক্রয় করে থাকেন। কিন্তু জ্বালানি সহ গুড় তৈরির আনুষঙ্গিক সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে তিনশ টাকা কেজি দরে গুড় বিক্রি করেও বিক্রেতারা খুব বেশি লাভবান হচ্ছেন না।যে কারণেই তাদের উত্তরসূরিরা এই পেশায় আসতে নারাজ। প্রতিদিন পরন্ত বিকালে খেজুর গাছগুলি একের পর এক বরাবরের নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ভোটা কেটে, সবগুলি গাছে হাঁড়ি ঝুলাতে ঝুলাতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের আঁধার নেমে আসে। আবার পরদিন কুয়াশা ঢাকা ভোরে সকলে যখন লেপ মুড়ি দিয়ে শীত ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন তখন সংশ্লিষ্ট গাছি ভোরের কনকনে ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করেই আগের দিন সন্ধ্যায় লাগানো কুয়াশায় ভেজা খেজুর গাছ থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রসে ভর্তি হাঁড়িগুলি নামাতে ব্যস্ত থাকেন। তারপরেও শম্ভু দেবনাথ, শহিদ মিঞারা তাদের বাপ দাদার পেশাটাকেই আঁকড়ে ধরে আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন, স্বপ্ন দেখছেন।প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার সরকারী কোনও উদ্যোগ কিংবা পরিকল্পনা অদ্যাবধি কোনটাই পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে অচিরেই প্রকৃতির ওই অপরূপ সৃষ্টি খেজুর গাছের বিলুপ্তির আশঙ্কা করছেন এছাড় সংশ্লিষ্ট মহল।

Dainik Digital

Recent Posts

প্রোগ্রেসিভ ইউথ ক্লাবে ফুঁটে উঠবে ‘নর্থ সেন্টিনাল আইল্যান্ড’!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-আর মাত্র একটা দিনের অপেক্ষা, এরপরই শাস্ত্র মতে প্রত্যেকটি প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে পূজিত হবেন…

18 hours ago

গ্যান্ডিয়োস্ ক্লাবে নেপালের পকোডা মন্দির!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-আর বাকি দুদিন। মা আসছেন মর্তে দোলায় চেপে। প্রতিটি ক্লাবে প্রস্তুতি প্রায় শেষের…

18 hours ago

পাকিস্তানে বিমানবন্দরে বিস্ফোরণ!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-আচমকা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল পাকিস্তানের করাচি বিমানবন্দর এলাকা। রবিবার রাতে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের…

19 hours ago

জমি হস্তান্তর, মুখ্যমন্ত্রীকে তীব্র আক্রমণ সুদীপের!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-মণিপুরের একটি বেসরকারী সংস্থাকে অনৈতিকভাবে আটাশ একর জায়গা হস্তান্তর করার গুরুতর অভিযোগ আনলেন…

23 hours ago

কংগ্রেস বিধায়কের অভিযোগ অসত্য ও বিভ্রান্তিকর: সুশান্ত!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-সৃজাহসপিটাল নিয়ে বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মণের অভিযোগ অসত্য ও বিভ্রান্তিকর বলে জানিয়েছেন খাদ্য,…

23 hours ago

আ মরি বাংলা ভাষা!!

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাংলা ভাষা ক্লাসিকেল ল্যাঙ্গুয়েজ স্বীকৃতি ও মর্যাদা পেলো। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গত বৃহস্পতিবার…

23 hours ago