আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও আজকের ভাবনা

 আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও আজকের ভাবনা
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

“Break the Bias” অর্থাৎ পক্ষপাত ভেঙ্গে দাও- এই থিম নিয়েই এই থিম নিয়েই আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি। জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের পর প্রতিবছর এই দিনটি এক একটি থিম নিয়ে পালিত হয় এবং বর্ষব্যাপী সেই অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মপ্রক্রিয়া চলতে থাকে।
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যানকর অর্ধেক তাঁর করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”- তা সত্ত্বেও সমাজে বা গৃহকোণে তাঁকে দেওয়া হয় না সমান মর্যাদা। এমনকি কর্মক্ষেত্রেও সমান শ্রমের বিনিময়ে মেলে না সম বেতন। সমবেতন ও সমমর্যাদার দাবিতে বিংশ শতকের শুরুর সকল কর্মরতা নারী ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। ১৯৮০ সালে নিউ ইয়র্কে প্রথম জমায়েত হয়। সেখানে তাদের চকরিতে কর্মবিরতি ও বেতনবৃদ্ধি এবং ভোটাধিকার প্রদানের দাবিও জানান। এরপর ১৯১০ সালে ক্লারা জেটকিন শ্রমজীবী মহিলাদের একটি নির্দিষ্ট দিনে সমবেত হবার পরামর্শ দেন। এই সন্মেলনে ১৭ টি দেশের প্রায় ১০০ জন কর্মজীবী মহিলা উপস্থিত ছিলেন। ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ প্রথমবারের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একসাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হলেও তখন পর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা হয়নি। ইতিমধ্যে ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ান মহিলারা বিরক্ত হয়ে রুটি( খাদ্য) ও শান্তির জন্য প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এই প্রতিবাদ এতটাই জোড়ালো ছিল যে, সম্রাট নিকোস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সেইসাথে সেখানকার মহিলারা ভোটাধিকার পান। যেদিন রুশ নারীগন এই আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই দিনটি ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি আর গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৮ মার্চ। সেই থেকে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা হলেও আন্তর্জাতিক তথা সরকারি স্বীকৃতি পায় ১৯৭৫ সালে।

পারিবারিক, ব্যক্তিগত বা পেশাদার জীবনে একজন নারীকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আজকের এই একবিংশ শতকে তথ্য প্রযুক্তির আলোকে সভ্যতা বহুদূর এগিয়ে গেলেও বহু মন্দির বা মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। পুজোপার্বণে আনুসঙ্গিক সকল কাজ করলেও সংকল্প হয় গৃহকর্তার নামে- এমনকি হোম যজ্ঞাহুতিতেও পুরুষদেরই অগ্রাধিকার। পরিবারেও পুত্র সন্তানদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। তাই বর্তমান সময়ে নারী দিব উদযাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা বজায় রাখা। আজও বিশ্বের নানা স্থানে নারীদের পুরুষের সমান অধিকার নেই। শুধু তাই নয় মেয়েরা নানাদিকে এগিয়ে যেতে চাইলে অজুহাতের বেড়াজালে তাদের চলার পথ রোধ করা হয়- তা সে নারী স্ত্রী-কন্যা-মাতা যাই হোক। নারীর পদোন্নতিতে যেমন আপত্তি তেমনি নারীর অধীনে চাকরি করাতেও আপত্তি। অনেক দেশে নারী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিক থেকেও পিছিয়ে রয়েছে। এছাড়া নারী নির্যাতনের ঘটনাও ভারত সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। রাজনৈতিক প্রাঙ্গন থেকে সরকারি আমলা, গৃহকোণ থেকে কর্মক্ষেত্র- সর্বত্রই নারীকে নানাবিধ সমস্যায় বেধে রাখা হয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম অনুযায়ী চিকিৎসা ক্ষেত্রে ৭০% মহিলা কাজ করলেও মাত্র ২৪.৭% স্বাস্থ্যমন্ত্রীই একজন নারী। রাষ্ট্রসংঘের মতে, পৃথিবীতে মাত্র তিনটি দেশের সংসদে ৫০% বা তার বেশি নারী রয়েছে। মাত্র ২২ টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান পদে আসীন রয়েছে নারী। এমনকি পৃথিবীর ১১৯ টি দেশে কখনো নারীরা রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকা পালনের সুযোগ পাননি। অতিমারি কোভিডের সময়ও নারী নেতৃত্ব দিয়েছে দক্ষতার সঙ্গে এবং সফলও হয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্র বা বিজ্ঞানী বা সেবিকা – সর্বত্রই তাদের উপস্থিতি পরিস্থিতিকে উন্নত করেছে। তবে এক্ষেত্রেও ফলাফল হতাশাজনক। রাষ্ট্রসংঘ জানিয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী নিজের পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় ১১% হারে বেতন কম পেয়েছেন প্রথম সারির করোনা নারী যোদ্ধাগন, যা বেতন বৈষম্যকে প্রকাশ করে।
তবে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে মানসিকতাও। নারী পুরুষ সমতা বিধান প্রয়াস বাড়ছে- বাড়ছে পক্ষপাত দূর করে সমমর্যাদা দানের প্রয়াসও। আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি তাই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে নারীর কৃতিত্বকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য পালিত হয়- গড়ে তোলা হয় নারীকে মর্যাদা দানের সচেতনতা। আফগানিস্তান, চিন, কম্বোডিয়া, নেপাল এবং জর্জিয়ার মতো বহু দেশে এই ৮ মার্চ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, কিছু দেশে অর্ধদিবস ছুটি দেওয়া হয়। কিছু দেশে এই দিনটিতে শিশুরা তার মাকে, পুরুষরা তার স্ত্রী-বন্ধু-মা-বোনকে উপহার হিসেবে ফুল দেয়। যদিও এই দিনটি উদযাপনের পদ্ধতি এক একটি দেশে একেকরকম, তাসত্বেও এর উদ্দেশ্য সর্বত্র একই- নারীর সমতা প্রদান করা- পক্ষপাত ভেঙে দেওয়া।
প্রতিবছর এই দিনটি পালিত হবে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, কিন্তু এই দিনটির যথার্থ সার্থকতা সেইদিন আসবে যেদিন কন্যাভ্রূণ হত্যা হবেনা, পণের জন্য বধূ নির্যাতন ও খুন বন্ধ হবে, নারীর প্রতি শোষণ থাকবেনা, ফৌজদারি মামলা হবেনা, এমনকি ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করাও হবে না। যেদিন আমরা ‘কথায় বড়ো না হয়ে কাজে বড়ো হব।’
—–অর্পা রায় চৌধুরী

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.