আপনা মগ্ন আপনি!!

 আপনা মগ্ন আপনি!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অনলাইন প্রতিনিধি :-অল্পবয়স্কদেরই যেন ভারতদর্শন করানো হয়, বিশ্বদর্শনেরও যথাসাধ্য চেষ্টা হয়,কারণ তাদেরই চোখ আর মন হল এই সুন্দরী মোহময়ী পৃথিবীর মধুরিয়া আস্বাদের জন্য শুধু আকুল নয়, উপযুক্তও বটে।’সাতষট্টি বছর বয়সে নিজের আত্মজীবনী ‘তরী হতে তীর’-এ কথা লিখেছিলেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ বামপন্থী চিন্তক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।তিনি থাকলে আজকের নবীন প্রজন্মকে নতশির হয়ে মোবাইল ফোনে বুঁদ থাকতে দেখে কী বলতেন জানা নেই।তবে এটা তর্কাতীত ভাবে সত্য এবং দুর্ভাগ্যজনক যে, সুন্দরী মোহময়ী এই সসাগরা ধরিত্রীকে সুকুমার মন তো বটেই,পরিণত মনও সে ভাবেই হৃদয়ঙ্গম করছে, যে ভাবে তাদের করাচ্ছে কৃত্রিম মেধাসম্পন্ন আন্তর্জাল।অবাক হতে পারার ঐশ্বর্য,সে চোখ হোক বা মন,বয়সের হাত ধরে ক্রমে হারাতে থাকে। এর কারণ হিসাবে কারও সিগমুন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্ব মনে পড়তে পারে,কারও কার্ল মার্ক্সের,কারওবা উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কথা। বিস্মিত হতে পারার মতো সংবেদনশীল ও সৃষ্টিশীল না হতে পারা এক দুর্ভাগ্য।প্রথম দেখা পুরীর সমুদ্র বা পাহাড় বেয়ে নেমে আসা সর্পিল নদীর স্রোত।প্রথম দেখা সে কারণেই শ্রেষ্ঠ দেখা।মানুষ যে আজকাল কিছু দেখছে না, এখন চোখের সামনে নিত্য দিন তা দেখতে হচ্ছে।বাস, ট্রেন, টমটম, অফিস-কাছারি সর্বত্র বিপুলসংখ্যক মানুষ নতশির ও স্থিরদৃষ্টি,হাতের স্মার্ট ফোনের পর্দায় বিভোর, যেন আঠায় আটকে যাওয়া মাছি।চায়ের দোকান, বারোয়ারি আড্ডার পরিচিত ভঙ্গি এখনও থাকলেও, নেই বন্ধুদের অবিরল পারম্পরিক বাক্যালাপ।আয়োজন সম্পূর্ণ করেও সকলে যেন আপনা মগ্ন আপনি।খেলায় বা প্রেমে, চ্যালেঞ্জে,প্রতিহিংসায়,প্রতিবাদে প্রত্যুত্তরে,ক্রয়ে-বিক্রয়ে, সাফল্য বা ব্যর্থতায়, সংবাদে-বিসংবাদে,বিজ্ঞানে বা অপপ্রচারে,অধ্যাত্ম্য বা আস্বাদনে-যে যে ভাবে হোক সারা বিশ্বের সঙ্গে কম-বেশি সংযুক্ত।তবে সকলেই কম-বেশি নতশির,স্থিরদৃষ্টি!জাপানিদের নাকি মাত্রাতিরিক্ত ছবি তোলার অভ্যাস।এমন একটি রসিকতা চালু আছে যে, জাপানিরা বিশ্ব দেখেন লেন্সের মধ্য দিয়ে।অধুনা আমরা সবকিছুই দেখছি মোবাইল ক্যামেরার মধ্য দিয়ে।টেবিলে সাজানো খাদ্যসম্ভার থেকে মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা, বিলোনীয়ার প্রান্তরে বাউলের গান,দুর্গাপুজোর ঠাকুর থেকে মণ্ডপসজ্জা- দেখে হৃদয়ঙ্গম নয়,বরং মানুষ বিভোর ছবি তুলতে, রিল বানাতে এবং সামাজিক মাধ্যমে তা ‘পোস্ট’ করতে।এ যেন এক আত্মবিপণনের হট্টমেলা। সমাজমাধ্যমে কত মানুষ ব্যক্ত করলেন তাদের পছন্দ, প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন কতজন, ক্ষণে ক্ষণে তা দেখে আত্মমুগ্ধতায় বুঁদ হওয়ার আয়োজন।এই সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে নিজের যদি দেখা বা শোনা নাও হয় কিছু, যদি সহমানুষের অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাতেও কোনও পরোয়া নেই।মোবাইল আসক্তি বা নিজেকে নিরন্তর দেখিয়ে চলার অভ্যাসে তুলনায় তরুণতরদের মাঠ ছেড়ে দিতে রাজি নন বড়রাও।কোথায় সঞ্চিত হবে এত ছবি,কত বিপুল সংগ্রহ একটি ফোন বা কম্পিউটারে রেখে দেওয়া সম্ভব,প্রতি মুহূর্তের ব্যক্তিগত যাপনকে ধরে রাখার সাধ সম্ভব করে তুলতে কী কী দরকার,প্রশ্ন অনেক।উত্তর কিছু জানা, বাকিটা অজানা।এ ভাবে সবাইকে সবকিছু দেখাতে গিয়ে এবং সবার সব কিছু দেখতে গিয়ে চার পাশের কত কিছু যে দেখা হচ্ছে না!সব কিছুকে মেলাতে গিয়ে তৈরি হচ্ছে বীভৎস বিচ্ছিন্নতা, বিশ্বের সমাচার পেতে গিয়ে ঘরের পাশের আরশিনগরের সংবাদ পৌঁছচ্ছে না।চলার পথে পোস্টার-সাইনবোর্ড-দেওয়াল লিখন পড়ে যে শেখা, যানবাহন, ডাক্তারবাবুর চেম্বার, সংবাদপত্র-ম্যাগাজিন পড়ে যে ‘জ্ঞান’ অর্জন,অথবা ট্রেন-বাসের জানালায় মুখ রেখে দেখার যে আশ্চর্য অভিজ্ঞতা, তা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ। অপরাজিত ছবিতে ট্রেনের বাইরের দৃশ্যপট দেখিয়ে সত্যজিৎ রায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অন্ধ্ররা কাশী ছেড়ে ফিরে আসছে সুজলা সুফলা শ্যামল বঙ্গদেশে।এখন সবাই গান শোনে, গেম খেলে, চ্যাট করে।অথচ চার পাশে চোখ মেলে দেখে না কিছু। আজ এই দেখানোর উৎসবে মগ্ন সমাজে,সর্বত্র সারি সারি নতশির মানুষকে দৃষ্টিসুখ সম্মোহন থেকে উদ্ধার করার দায়িত্ব কে নিজের কাঁধে তুলে নেবে,বা আদৌ তা সম্ভব কি না, কার কাছে সে উত্তর আছে, সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কালের গর্ভে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.