আর্থিক অসাম্য!
বিজ্ঞানী ডারউইনের জগতজয়ী তত্ত্ব যা জনমুখে ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ নামে পরিচিত, তা সময়ের হাত ধরে ‘সারভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট’ হয়েই এখন গোটা দুনিয়াকে কঠিন থেকে কঠিনতর সঙ্কটের দিকে নিয়ে চলেছে। যোগ্যতমের উদ্বধনকে যিনি প্রাকৃতিক নিয়ম বলে বর্ণনা করেছেন, সেই যোগ্যতম বলতে বর্তমান সমাজে ধনী থেকে ধনীতরদের বেলায় ১০০ শতাংশ যে সঠিক ইঙ্গিত তা গোটা দুনিয়ার দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়। একদিকে গোটা দুনিয়া জুড়েই আর্থিক সঙ্কট, ভোগাচ্ছে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্মহীনতা, বেকারত্ব, শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া, প্রশিক্ষণ না থাকা বিশাল শ্রমশক্তি গোটা দুনিয়ার সামনেই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
এই সংকট আর অর্থনীতির অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে আর্থিক অসাম্য এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ ফেলছে। যদিও আর্থিক অসাম্য, মানুষের আয় কমে যাওয়া, অপুষ্টির স্তর বেড়ে যাওয়া-এগুলো নতুন কোন বিষয় নয়। উদ্বেগের সেটা তা হলো, গত ২ বছরে বিশ্বজুড়ে এই অসাম্য, মানুষের মানুষে আর্থিক পি ব্যবধান অপ্রতিহত গতিতে যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে মানব সমাজ ব্যবস্থা গোটা বিশ্বের আর্থ সামাজিক ছি কাঠামোকেই সম্পূর্ণ অচেনা করে দেবে। আরও উৎকন্ঠার বিষয় হলো, গোটা বিশ্বজুড়ে বৈষম্য আর আর্থিক বিপন্নতার একই চিত্র হলেও এই ব্যবধান বা ফারাক ভারতেই সবচেয়ে বেশি।
অর্থাৎ আর্থিক অসাম্যের নিরিখে ভারতই এখন বিশ্বের প্রথম সারিতে। আন্তর্জাতিক দারিদ্র দূরীকরণ কাজের সঙ্গে যুক্ত দাতব্য সংস্থা অক্সফাম এ বছর যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার, চ দিনের পর দিন যেভাবে অসাম্যের পৃথিবী গড়ে উঠেছে তাতে ধনীরাই যি কেবল টিকে থাকতে পারবে। অক্সফাম বলছে, ভারতের ২০০০ সালে অতি ধনী ব্যক্তি ছিলেন মাত্র ৯ জন। অতি ধনী বলতে যারা একশো কোটি ডলারে বেশি সম্পদের মালিক তাদের কথাই বলা হচ্ছে। অথচ ২০১৭ সালে এই সংখ্যাটা ৯ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০১ জন। আর বর্তমান সময়ে অর্থাৎ ২০২৩ সালের জানুয়ারী মাস অব্দি এই সংখ্যাটা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬ জন।
এই যে হু হু করে ভারতে অতিধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি, সেটাই ভারতের মতো দেশে কোটি কোটি মানুষের টিকে থাকাই দায় করে দেবে। এই রেকর্ড হারে অতিধনী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, এটাই দরিদ্র মানুষের সংখ্যাকে কয়েকগুণ হারে আরও নিঃস্ব করে দিচ্ছে। পরিসংখ্যান অ দেখাচ্ছে, ২০২০ সাল থেকে গোটা বিশ্বে যত সম্পদ বেড়েছে এর দুই তৃতীয়াংশের মালিক হবেন মাত্র পৃথিবীর ১ ভাগ মানুষ। ভারতের চিত্রটা আরও উদ্বেগের ও লজ্জার। রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে গরিব মানুষের বাস ভারতে। মানব উন্নয়নসূচকই হোক, কিংবা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক- সর্বত্রই ভারতের অবস্থান প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেকটা খারাপ।
অসাম্য কিংবা আর্থিক বিপন্নতা বা ব্যবধান তিন রকমের হয়। যদি দেখা যায় ধনীরা আরও অনেক ধনী হচ্ছেন কিন্তু সাধারণ মানুষ যেখানে ছিলেন সেখানেও আছেন সেটা এক ধরনের অসাম্য। যদি দেখা যায় ধনীরা যেখানে ছিলেন সেখানেই আছেন, অথচ সাধারণ বা গরিব মানুষের আর্থিক ছিলেন সেখানেই আছেন, অথচ সাধারণ বা গরিব মানুষের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে এটা এক ধরনের অসাম্য বা ব্যবধান। আর যদি দেখা যায় ধনীরা যেখানে ছিলেন এর তুলনায় অনেক দ্রুতলয়ে ধনী হয়েছেন, অপরদিকে সাধারণ মানুষ বা দেশের বাদবাকি জনতা যেমনটা ছিলেন সেই তুলনায় আরও খারাপভাবে আর্থিক দিক দিয়ে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছেন তবে সেটা হচ্ছে দেশের জন্য ভয়ঙ্করতম বিপজ্জনক প্রবণতা ।
উৎকণ্ঠার বিষয় হলো ভারতের মতো দেশে এই আর্থিক বৈষম্যটা হচ্ছে এই তৃতীয় মাত্রার, অর্থাৎ ধনীরা ধনী হচ্ছেন আর দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছেন। অক্সফাম বলছে, ভারতে এই সময়ে যত সম্পদ বেড়েছে তার ৬২ শতাংশ সম্পদের মালিকানা পেয়েছেন ১ শতাংশ মানুষ। অথচ নিচের দিকে থাকা ৫০ ভাগ মানুষ মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদের মালিক। অর্থাৎ ভারতের মতো দেশে প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ আজ রিক্ত ও কপর্দকশূন্য। গত বুধবার সংসদে পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ হয়েছে। এর প্রাক্কালে প্রকাশিত হয়েছে আর্থিক সমীক্ষা ও পূর্বাভাস।
সেই সমীক্ষাতেও আশঙ্কা করা হয়েছে দেশে আগামী অর্থ বছরেও মূল্যবৃদ্ধির হার চড়া থাকবে। এর অর্থ হলো মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকল গোটা অর্থব্যবস্থার সঙ্গে দেশের বিশাল পরিমাণ জনসংখ্যাকে আরও ভোগাবে। বাড়তে পারে আর্থিক মন্দা। অর্থনীতিতে বলা হয়ে থাকে, উন্নতি উপর থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ও পরিসংখ্যান এদেশে অন্য ইঙ্গিতই দিচ্ছে। এই অবস্থায় অসাম্যের ভারতে সমানাধিকার যে শুধুই কথার কথা তা দিনের আলোর মতোই এখন পরিষ্কার।