আশা না পুরিল!
তৃতীয় মোদি সরকারের প্রথম বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের টানা ষষ্ঠবার বাজেট পেশের রেকর্ড ভেঙে নতুন নজির গড়লেন ঠিকই, তাতে সাধ কিছুটা মিটলেও বিশেষত সাধারণ নাগরিকের আশা পূরণ হল বলা যায় না। দেড় ঘন্টার বাজেট-বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানালেন, ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার এখন চমকপ্রদ।মূল্যবৃদ্ধির রকেট গতি নিয়ে সাধারণ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা হলেও সীতারমন জানালেন, বর্তমানে দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার অনেকটাই কম, মাত্র ৩.১ শতাংশ। অর্থশাস্ত্রীরা বলেন,৪ শতাংশের নিচে মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতিকে বেঁধে রাখতে পারলে দেশের পক্ষে মঙ্গল।
কেন এই বাজেটে ‘সাধ’ মিটল এবং কেনইবা আশা পূরণ হলো না, সংক্ষেপে তা এই রকম: অষ্টাদশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথম বাজেটে অর্থমন্ত্রী নয়টি ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।যে কর্মসংস্থানের হতাশাজনক চিত্রটি সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিরোধীরা শাসকদের সর্বাধিক চেপে ধরেছিলেন,সেই কর্মসংস্থানে অতিরিক্ত জোর দিয়েছেন তিনি।জোর দিয়েছেন মধ্যবিত্ত, দক্ষ এবং অদক্ষ সর্বস্তরের শ্রমিকদের দক্ষতা ও উদ্ভাবনে।গরিব, মহিলা, কৃষক, বিশেষত কৃষি উন্নয়নে বাড়তি বরাদ্দের ঘোষণা করেছেন।যে তৈলবীজে আমরা এখনও আমদানির উপর নির্ভরশীল, সেই খাতে আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াতে বাড়তি বরাদ্দ করেছেন।মোট বাজেট বরাদ্দের মধ্যে মূলধনী ব্যয়ের পরিমাণ গতবার ছিল যেখানে ছিল ১ লক্ষ ৬২ হাজার কোটি টাকা,এবার তা বেড়ে হয়েছে ১ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি।এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ক্ষেত্রে বরাদ্দ ১ লক্ষ ৫ হাজার ৫১৮ কোটি।যদিও মুদ্রাস্ফীতির কথা মাথায় রাখলে এই বৃদ্ধি খুব বেশি নয়।’বিকশিত ভারত’ গঠনের লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদির উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প ‘মেক ইন ইন্ডিয়ায় জোর দিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৬ লক্ষ ২১ হাজার কোটি টাকা করার কথা ঘোষণা করলেন।গত ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে এই অঙ্ক ছিল ৫ লক্ষ ৯৪ হাজার কোটি টাকা।প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এমন ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলেই দেন, বাজেটের ১২.৯ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। প্রধানমন্ত্রী মোদি দাবি করেছেন, কেন্দ্রীয় বাজেট সমাজের প্রতিটি শ্রেণীকে শক্তিশালী করবে।এই বাজেট দেশের গরিব মানুষ, গ্রাম এবং কৃষককে উন্নতির পথে নিয়ে যাবে’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন,এই বাজেট নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে শক্তি জোগাবে।নিঃসন্দেহে জোগাবে।কারণ বিত্তবানদের মাথায় বাড়তি কর চাপানো হয়নি,উল্টে মধ্যবিত্ত
বিনিয়োগকারীদের স্বস্তি দিতে স্বল্পমেয়াদি মূলধনী করছাডের সীমা বৃদ্ধি করেছেন।যদিও এ নিয়ে লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। আর একটি বিষয় অবশ্যই লক্ষণীয়, তৃতীয় মোদি সরকারের অন্যতম দুই শরিক দলশাসিত দুটি রাজ্য বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশের উন্নয়নের জন্য কার্যত দানপাত্র উপুড় করে দেওয়া।বিরোধীরা যাকে ‘বিহার অন্ধ্রের বাজেট’ বলে কটাক্ষ করেছেন।বোঝা যাচ্ছে, এই বাজেটকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করেই আগামী বছর বিহার বিধানসভা নির্বাচনে এককভাবে পাটনার তখত দখলের লড়াইয়ে ঝাঁপাবে বিজেপি।
এতকিছুর পরেও ‘আশা পুরিল না’ এই কারণেই যে, বিত্তবানদের উপরে বেশি কর আদায় করে সেই টাকার আরও বেশি কর্মসংস্থানের দিশা থাকলে ভালো হতো। ধনীদের করের টাকা দেশের গতিভঙ্গ উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যবহার করলে কর্মীদের চাহিদা বাড়াত।বেশি কর্মী তৈরি হলে চাহিদার বান ডাকে।চাহিদা বাড়লেই নতুন বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ে। সুস্থায়ী মেয়াদে বাড়ে জিডিপি। ২০০৯-১১ সালে বেসরকারী লগ্নির বৃদ্ধির হার ছিল ২৭ শতাংশ।২০২১-এর প্রথম ত্রৈমাসিক থেকে ২০২৩- এর চতুর্থ ত্রৈমাসিকের মধ্যে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশে। ২০২৪-এর প্রথম দুটি ত্রৈমাসিকে তা আরও কমে হয়েছে ৫ শতাংশ।দেশে আর্থিক সংস্কার হয়েছে তিন দশকেরও বেশি সময় আগে, কিন্তু এখনও বিশ্বের মোট রপ্তানির মাত্র তিন শতাংশ আসে ভারত থেকে। ২০২৩-২৪ সালে ডলারের অঙ্কে ভারতের রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে ৩ শতাংশ।
রপ্তানি বাড়াতে চাইলে আমদানি শুল্ক কমাতে হয়। কারণ, আজকের দুনিয়ায় যে সংস্থাই রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করুক না কেন, উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন করতে হলে তাকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অন্তর্বর্তী পণ্য আমদানি করতেই হবে। আমদানি শুল্ক চড়া হলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, ফলে ভারতীয় পণ্য বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হারাবে।অন্যদিকে, আমদানি শুল্ক কম হলে উৎপাদন ব্যয়ও কমে, ফলে স্বদেশি পণ্য বিদেশের বাজারে দাপিয়ে বেড়াতে সক্ষম হয়। কিন্তু এমন কোন সুসংহত ঘোষণা শোনা গেল না অর্থমন্ত্রীর মুখে।