আস্থার পরিবেশ জরুরি।

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

উত্তর পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট রাজ্য মণিপুরে গত এক মাসের বেশি সময় ধরে যে ধরনের হিংসা, জাতিগত হানাহানি এবং মৃত্যুর দৌড় চলছে, সাম্প্রতিককালে ভারতের কোনও রাজ্যে এমনটা ঘটেনি।গত ৩ মে থেকে শুরু হওয়া জাতিগত হিংসায় এ পর্যন্ত সরকারীভাবেই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।এই সহিংসতার ঘটনায় নিহতদের মধ্যে আধা সেনার কমাণ্ডো থেকে জাতীয় স্তরের খেলোয়াড়, সরকারী উচ্চপদস্থ আধিকারিক থেকে শুরু করে নিরীহ গ্রামবাসী বাদ যাননি কেউই। আক্রান্তদের তালিকায় শাসকদলের মন্ত্রী, বিধায়করাও রয়েছেন। হিংসার আগুনে অগণিত বাড়িঘর, প্রতিষ্ঠান, সরকারী সম্পত্তি পুড়েছে।গৃহহীন হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা হিংসা থামাতে সেনার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে গোটা রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু হিংসা থামার কোনও লক্ষণ নেই মণিপুরে। প্রকাশ্যেই অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র হাতে হিংসা ও অশান্তি ছড়াতে দুর্বৃত্তরা ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, মণিপুরের বিভিন্ন স্থানে সেনাদের তল্লাশি অভিযানে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত হচ্ছে। তল্লাশি অভিযানের সময় ম্যাজিস্ট্রেটরাও হাজির থাকছেন। কিন্তু কোনওভাবেই ডবল ইঞ্জিন সরকার মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। শুরুতে মনে করা হচ্ছিল পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে মণিপুরে সম্ভবত রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পদক্ষেপে যেতে পারে কেন্দ্র। কিন্তু তেমনটা না করে গোটা রাজ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর মণিপুর পুলিশের ডিজিপি-কে সরিয়ে দিয়ে অমিত শাহের বিশ্বস্ত পুলিশ কর্তা ত্রিপুরা- মণিপুর ক্যাডারের আইপিএস রাজীব সিংকে দায়িত্বে আনা হয়। ঘটনার ২২ দিন বাদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২৯ মে মণিপুরে ছুটে আসেন এবং চারদিন সেখানে আস্তানা গেড়ে গোটা পরিস্থিতির উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করেন।কিন্তু তাতে ইতরবিশেষ কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।সেনা নামিয়ে,কার্ফু জারি করে, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করেও পরিস্থিতিকে কোনওভাবেই যে কাবু করা যাচ্ছে না, থেমে থেমে বেড়ে চলা হিংসার তাণ্ডবের ভয়াবহতা থেকেই সেটা একরকম পরিষ্কার। অথচ বিস্ময়কর ঘটনা হলো, প্রায় ৩৫ লক্ষ জনসংখ্যার ছোট রাজ্য মণিপুরে অশান্তি ও হানাহানি এক মাসের বেশি সময়কাল ধরে চললেও এই সংবেদনশীল ইস্যু নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এমনকি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর কার্যত নীরব। রাজ্যের গোটা আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কেন্দ্র রাষ্ট্রপতি শাসন জারি না করেও পরোক্ষে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতেই অনেকটা তুলে নিয়েছে। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে এখনও বীরেন সিং অধিষ্ঠিত থাকলেও তিনি যে এই মুহূর্তে শুধুই পুতুল শাসক একথা অস্বীকারের অবকাশ নেই। আসলে মণিপুরের পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে মূল সমস্যার গভীরে যাওয়া যতটা জরুরি, তার চেয়েও ডবল ইঞ্জিন সরকারের সামনে বেশি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক।কারণ ব্যক্তি বীরেন সিংয়ের চেয়েও সম্প্রদায়গত প্রতিনিধিত্বকারী বীরেন সিং এখন গলার কাঁটা হয়ে বিধছে বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে। মণিপুরে হিংসা শুরুর আগে থেকেই বীরেন সিংকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছিল দলের ভেতরেই একাংশ মহল থেকে। কিন্তু জনসংখ্যার নিরিখে ৩৫ লক্ষ জনবসতির মণিপুরে বীরেন সিং যে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা হলেন মেইতেই জনগোষ্ঠীর। এই মেইতেই সম্প্রদায় রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫২ শতাংশ। লক্ষণীয় হল ৫২ শতাংশ মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষ মাত্র ১৫ শতাংশ জমির মালিক। অথচ নাগা-কুকিরা পাহাড়বাসী খ্রিস্টান সংখ্যালঘু হলেও পার্বত্য ও জঙ্গলে বাস করার কারণে তারাই বাদবাকি ৮৫ শতাংশ জমির মালিক।অপরদিকে মেইতেইরা হচ্ছে মণিপুরে বিজেপির মূল শক্তি।এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বনাম সংখ্যালঘুর দ্বন্দ্ব।জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যার তুলনায় জমির পরিমাণের বিভিন্নতা,ধর্মীয় বৈচিত্র এবং অন্যান্য ভেদাভেদ স্থানীয় ও বহিরাগত সংঘাতকে মণিপুরে বিপজ্জনক চেহারায় নিয়ে যায়।যার সমাধান করতে দলের ভেতর এবং বাইরে পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং।এই জটিল রসায়নের মধ্যে দাঁড়িয়ে মেইতেই জনগোষ্ঠীর উপর বীরেন সিংয়ের প্রভাব ও প্রতিপত্তির কথা মাথায় রেখে অমিত শাহদের পক্ষে মণিপুর ইস্যুতে সঠিক ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা কার্যত দলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে সেই আশঙ্কাতেই রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের প্রশ্নে মণিপুরে রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। অথচ মণিপুরের মতো একই ধরনের পরিস্থিতি অবিজেপি শাসিত অন্য রাজে ঘটলে তার পরিণাম যে অন্য হিসাব করেই এগিয়ে যেতো রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল এই সম্পর্কে নিশ্চিত।এই অবস্থায় শুধুই সেনাবাহিনী নিয়োগ,পেশিশক্তি ব্যবহার কিংবা মণিপুরকে খণ্ডিত করতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারির মধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি আটকে থাকেন তাহলে ডবল ইঞ্জিনের সরকারের পক্ষে মণিপুরে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের হবে।ভুলে গেলে চলবে না মাত্র দুই দশক আগেই আফস্পার বিরুদ্ধে মণিপুরে ২০০৪ সালে যে উত্তাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল,ইম্ফলে আসাম রাইফেল সদর দপ্তরের সামনে যে উত্তাল প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল,সেই পরিস্থিতি যেন পুনরায় কোনওভাবেই দানা বাঁধতে না পারে, সন্ত্রাসীদে যাতে পুরো মাত্রায় বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে আলোচনার টেবিলে বিবদমান সব পক্ষকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় সেই লক্ষ্যে সময় নষ্ট না করে কেন্দ্রকে জরুরি ভিওিতে এগিয়ে আসতে হবে।

Dainik Digital

Recent Posts

গয়নার ল্যাবে তৈরি হলো বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম রুবি!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-বাংলায় চুনি, ইংরেজিতে রুবি।চুনির রং কতটা টকটকে লাল, তার উপর এই মানিকের দাম…

8 hours ago

মুখ্যমন্ত্রীর মুখ বাঁচাতে পুলিশ প্রশাসনের নির্লজ্জ দ্বিচারিতা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-চাঁদারজুলুম নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে তথাকথিত সুশাসনের রাজ্যে প্রশাসনের নির্লজ্জ দ্বিচারিতা প্রকাশ্যে এলো।…

9 hours ago

কাজের বাজারে মন্দা!!

কেন্দ্রে ১০০ দিন পূর্ণ করল তৃতীয় মোদি সরকার।যদিও বর্তমান ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারকে মোদি সরকার আখ্যা…

9 hours ago

নিগো – অন্ধ প্রশাসন!!

নিগো বাণিজ্যের রমরমা চালানোর জন্যই কি ১৮ সালে রাজ্যের মানুষ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো?রাজ্যের আকাশ…

1 day ago

বিমানযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে পুলিশের তদন্ত শুরু!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-এয়ারইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের কর্মীর চরম গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণে রীতা বণিক (৫৯) বিমান যাত্রীর…

1 day ago

হরিয়ানাঃ পাল্লা কার পক্ষে?

হরিয়ানা কি বিজেপির হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে?শাসক বিজেপির হাবভাব দেখে তেমনটাই অনুমান করছে রাজনৈতিক মহল।প্রধানমন্ত্রী…

2 days ago