ইতিহাস বদলের অপচেষ্টা

 ইতিহাস বদলের অপচেষ্টা
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

দেশে একের পর এক জায়গায় মন্দির ও মুসলিম স্থাপত্য নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে । উত্তরপ্রদেশে সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালেই এই বিতর্ক ডানা মেলতে শুরু করেছিল । বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির চত্বরে জ্ঞানবাপী মসজিদ , মথুরায় শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানের সঙ্গে মসজিদ , তাজমহল নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক চলছিল গত বেশ কিছুদিন ধরেই । এই অনাহুত অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মধ্যেই কুতুব মিনার নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হলো । বিতর্কের সূচনা ইতিহাসকে নতুন করে নির্মাণ করার অভিপ্রায় থেকে । কারণ কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লীর কুতুব মিনার নির্মাণ করেননি । দিল্লীর এই মিনারটি নির্মাণ করেছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য । গত কিছুদিন ধরেই এমনই এক দাবিকে ঘিরে তোলপাড় গোটা দেশ ।

যে কারণে মুঘল যুগে কুতুবুদ্দিন আইবকের আমলে নির্মাণ হওয়া কুতুব মিনার এখন প্রশ্নচিহ্নে । প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েছে মিনারের অস্তিত্ব রক্ষা করা । আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়া সংক্ষেপে , এএসআইয়ের প্রাক্তন আঞ্চলিক নির্দেশক ধর্মবীর শর্মার এমনটা দাবি । তবে কুতুব মিনার নিয়ে এমন বিতর্কিত দাবি এই প্রথম নয় । এর আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র বিনোদ বনশলও নাকি দাবি করেছিলেন কুতুব মিনারের প্রকৃত নাম বিষ্ণু স্তম্ভ । ২৭ টি হিন্দু এবং জৈন মন্দিরের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে এই কুতুব মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল বলে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় । কিন্তু এবার বিতর্কের মাত্রা নতুন উচ্চতায় উস্কে দেওয়া হয়েছে অন্য একটি কারণে । এবার আর বিষ্ণু মন্দির বা বিষ্ণুস্তম্ভের কথা বলা হচ্ছে না । এবার সরাসরি কুতুব মিনারের সঙ্গে হিন্দু রাজা বিক্রমাদিত্যকে জুড়ে ফেলার চেষ্টাকে ঘিরে বিতর্কের পারদ নতুন মাত্রা পেয়েছে । এএসআইয়ের যিনি প্রাক্তন অধিকর্তা , সেই ধর্মবীর শর্মা দাবি করেছেন । কুতুব মিনার আসলে কুতুবুদ্দিন আইবকের সময়ে নির্মাণ হয়নি । এই মিনারটি তৈরি হয়েছিল রাজ বিক্রমাদিত্যের আমলে । আর সূর্যের গতিপথ পর্যালোচনা করার জন্যই নাকি তৈরি করা হয়েছিল এই মিনার । এই দাবিকে সামনে রেখেই হিন্দুত্ববাদীরা দাবি তুলেছিলেন কুতুব মিনারের পূর্বতন যে মন্দির সেটিকে পুনরুদ্ধারের জন্য যেন উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সেই প্রেক্ষিতে আদালতে এদিন হলফনামা দিয়ে এএসআই জানিয়েছে ১৯১৪ সাল থেকে কুতুব মিনারের সংরক্ষণ করা হচ্ছে । এখন তাই এই কাঠামোকে আর বদল করা সম্ভব নয় । তাই কুতুব মিনারে পুজো দেওয়ার যে ব্যবস্থা করার কথা দাবি করা হচ্ছে , যেহেতু কুতুব মিনারকে আর মন্দিরে রূপান্তর করা সম্ভব নয় , তাই সেখানে পুজো দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না । এএসআই অবশ্য আদালতকে একটা কথা পরিষ্কার করেই জানিয়েছে আমরা সংরক্ষিত জায়গাকে পরিবর্তন করতে পারি না । যে সময় কতুব মিনারকে সংরক্ষণ করা হয়েছিল,সেই সময় সেখানে কোন পুজোপাঠ হতো না।তাই এখন সেখানে নতুন করে পুজোর অনুমতি দেওয়ার ও সম্ভব নয়।আসলে মন্দির মসজিদ স্থাপত্য নিয়ে নতুন নতুন বিতর্কের যে প্রবণতা শুরু হয়েছে সেটা মোটেই দেশের জন্য স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয় । এই প্রসঙ্গে দিল্লী আদালতের একটি বক্তব্যও প্রধানযোগ্য তাতে বলা হয়েছে অতীতে অনেক ভুল হয়ে থাকতে পারে , অনেক অন্যায় হয়ে থাকতে পারে- সেকথা কেউই অস্বীকার করছেন না । কিন্তু মনে রাখতে হবে অতীতের ভুলের উপর ভিত্তি করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের শান্তি ও সুস্থিতির পরিবেশকে কোনভাবেই নষ্ট করতে দেওয়া যায় না । একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে , অযোধ্যা মন্দির ও বাবরি মসজিদ বিতর্ক সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আইনি লড়াইয়ের পর এই বিবাদের নিষ্পত্তি হয়েছিল । ১৯৯১ সালের প্লেসেস অফ ওয়ারশিপ ( স্পেশাল প্রভিশন ) আইনের মাধ্যমেই দেশের সমস্ত ধর্মীয় স্থানের চরিত্র সংরক্ষিত ।

এত কিছুর পরেও মথুরা নিয়ে সরব হয়েছে কিছু উগ্র ধর্মান্ধ মানুষ । ১৯৯১ সালের এই আইন যে কোনও উপাসনালয়ের ধর্মান্তরনকে নিষিদ্ধ করে । ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্টের পর যে কোনও ধর্মীয় উপাসনালয়ের ধর্মীয় চরিত্রকে রক্ষণাবেক্ষণের করেছে এই আইন । কিন্তু নতুন করে একের পর এক বিতর্ক নামে ফের অস্থির রাজনীতি শান্তি এবং সুস্থিতিকে নষ্ট করার যে অপপ্রয়াসে নেমেছে তা দেশের এবং দশের কোনও মঙ্গল আনতে পারে না । রাজনীতির আড়ালে উগ্র ধর্মান্ধরা যত দ্রুত সেটা উপলব্ধি করবেন ততই তা দেশকে সুরক্ষা দেবে । আচমকা যারা আজ কাশী বিশ্বনাথ মন্দির চত্বরে জ্ঞানবাপী মসজিদ , মথুরায় শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানের সঙ্গে মসজিদ কিংবা তাজমহল বিতর্ক ও কুতুব মিনার নিয়ে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন , যদি তাকে মান্যতা দেওয়া হয় তবে তা ভারতের সংবিধানের বুনোট ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকেই দূর্বল করে দেবে । গত ৮০০ বছর ধরে কুতুব মিনার প্রাঙ্গণে দেবদেবীরা যদি কোনও পুজোপাঠ ছাড়া দিব্যি থাকতে পারেন , তাহলে সেখানে নতুন করে পুজোপাঠ বা ধর্মীয় অনুশীলনের চেষ্টা সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয় । এক্ষেত্রে প্রশাসনকেও কঠোরভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র যাতে অটুট থাকে সেদিকে সর্বাগ্রে নজর দেওয়া জরুরি ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.