ইন্টারনেটকে পিছনে ফেলে দেশ মেতে উঠেছে সাবেকি গাজন উৎসবে

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

এয়োসংক্রান্তি,পাঁচকুমার, ছাতুসংক্রান্তি, নিতসিঁদুর, আদাহলুদ, রূপহলুদ, ফলগছানো, মধুসংক্রান্তি ব্রতের কথা আজ আর কেউ মনে রাখেন না। অথচ মহাবিষুব দিনে, চৈত্র সংক্রান্তিতে একসময় বাংলার গ্রাম-গঞ্জে এই সনাতনী উৎসব হত। যার মধ্যে এখনও টিকে আছে শুধু গাজন আর চড়ক। উত্তরবঙ্গে এর নাম ‘গম্ভীরা’। সমাজের একেবারে অন্ত্যজ শ্রেণিদের মধ্যে পাঁচদিন ধরে সন্ন্যাস নেওয়ার পর চৈত্রের শেষদিনে শুরু হয় গাজনের তিথি উৎসব। ‘গাজন’ নামটি গর্জন গাছ থেকে এসেছে। আবার অনেকের মতে; ‘ত্রিশূলধারী চরণের সেবা লাগি বাবা মহাদেব, ব্যোম ব্যোম’ গর্জন থেকেই এসেছে গাজন। তা নিয়ে হিন্দু পণ্ডিত আর বাঙলা ভাষাবিদদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। কিন্তু এই একটা দিন ডোম, হাড়ি, চামার ও কাহাররা সমাজের উঁচু বংশের লোকদের সম্ভ্রম ও প্রণাম পান। অন্ত্যজরা সমাজের উচ্চ শ্রেণির কাছে পূজ্য হন।কেউ কেউ বলেন মহাদেব কৃষক ছিলেন বলে উর্বরাশক্তির প্রতীক হিসাবে চৈত্র সংক্রান্তিতে ভারতের সমস্ত প্রদেশেই শিবের আরাধনা করা হয়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ বইতে উল্লেখ আছে; মহাদেবের আরেক নাম ‘নীলষষ্টিভাগ’। মহাভারতেও মহাদেবের এই নাম পাওয়া যায়। সনাতন কাল থেকে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন এই ‘নীলষষ্টিভাগ’ এর পুজো হত। পরে তা অপভ্রংশ হয়ে ‘নীলষষ্ঠীভাগ’ ও আরো পরে সংক্ষিপ্ত হয়ে ‘নীলষষ্ঠী’ হয়ে গেছে। ফলে আসল মানেই গেছে বদলে আর গাজনের উৎসবে সমাজে উঁচু বংশের লোকরা অন্ত্যজ শ্রেণির লোকদের কেন এই একদিন প্রণাম করেন, সে ব্যাপারে এক পৌরাণি কাহিনি আছে।পুরাণ অনুসারে; অন্ত্যজদের রাজা বাণাসুরের মেয়ে ঊষার প্রেমে পড়েন কৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধ।আর তা হাতেনাতে ধরে ফেলার পর ক্রুদ্ধ বাণাসুর বংশ মর্যাদা রাখতে অনিরুদ্ধকে হত্যা করতে এগিয়ে যান। সেসময় শ্রীকৃষ্ণ তা দেখতে পেয়ে সুদর্শন চক্র চালিয়ে বাণাসুরের দেহ টুকরো- টুকরো করে ফেলেন। বাণাসুর মৃত্যুর আগে শ্রীকৃষ্ণের কাছে বলেন, ঊষা শ্রীকৃষ্ণের বংশধরদের জননী হবে। তাই সারা বছরে অন্তত একটা দিন অন্ত্যজ শ্রেণির লোকরা যাতে উঁচু বংশের লোকদের কাছে পূজ্য হন,সেই বর দিন। শ্রীকৃষ্ণ তা মঞ্জুর করেন। আর মহাদেবের ভক্তরা বৈষ্ণবদের কাছেও এই একটা দিন সন্ন্যাসীর সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা পান। এ হল আসলে সামাজিক ভেদাভেদ দূর করে সংমিশ্রণের তত্ত্ব। সনাতন ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম, শাক্ত ও শৈবরা একাকার হয়ে গেল।অসমে গোরু অর্চনার জন্য সনাতন কাল থেকেই গ্রামে-গঞ্জে চলে আসছে ‘গোরুবিহু’ উৎসব। নববর্ষের দিন অসমে হবে ‘বহাগ বিহু’ উৎসব। নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশার উৎসব। চড়কের উৎসবের সঙ্গে কিন্তু সনাতন কাল থেকে জাদু বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। আদিকাল থেকে গর্জন, শাল বা গজারি গাছের এক বিশাল খুঁটি সারা বছর কোনো পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হত। নীলষষ্টিভাগের উৎসবের দিন সন্ন্যাসী বা ভক্তরা তা পুকুর থেকে তুলে তেল মাখিয়ে মাটিতে শক্ত করে পোঁতেন।এর নাম হল গাছ জাগানো। এই দিন থেকেই শুরু গাজন উৎসব।গাছ হল শিবলিঙ্গের বা শিশ্নের প্রতীক। আর পৃথিবীর ভূমি হল পার্বতী। গাছ জাগিয়ে মাটিতে পোঁতা আসলে যৌনপ্রতীকী ধর্মধারা বা উর্বরতা কামনার ব্যঞ্জনা বহন করে। এরপর গাছে বাঁশ বেঁধে চক্রকারে ঘোরার ব্যবস্থা হয়। তা দেখেই এসেছে চড়ক শব্দ।হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে উল্লেখ করা আছে,
এই চক্রাকারে ঘোরার পেছনে রয়েছে বছরের শেষে সৌরচক্র শেষ করার প্রতীক হিসাবে তুলে ধরা। সেদিক থেকে দেখলে এরমধ্যে সূর্যপুজোর ধারাও রয়েছে। কিন্তু এরসঙ্গে রয়েছে কাটারি, ঝাঁপ, কাঁটা ঝাঁপ ও বাণফোঁড়ার মতো আদিম কালের
জাদু বিশ্বাস’ বা ব্ল্যাক ম্যাজিক। ক্ষেত্র-গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে এরসঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আদিম শল্য চিকিৎসা। এই পদ্ধতিতে আদিম কালে হাঁপানি ও যক্ষা রোগ সারত। আর সন্ন্যাস নেওয়া ভক্তরা একে শিবের মহিমা বলে মানতেন। গাজনের সঙ সেজে নারদরূপের ভক্ত বা সন্ন্যাসী শিব ও দুর্গারূপী সন্ন্যাসীর ঝোলায় প্রতিটি গৃহস্থ বাড়ির সম্ভাব্য বিপদ- আপদ থেকে ওই বাড়িকে বাঁচানোর জন্য দরজার মাটির কিছুটা হরপার্বতীর দায়িত্বে চাপিয়ে দেওয়া হয়।দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জের মহিলারা নীলের ঘরে যে বাতি দেন, তাও কিন্তু মূল শব্দের অপভ্রংশ। আসলে ছিল নীলাবতী অর্থাৎ পার্বতীর সঙ্গে মহাদেবের বিয়ে।এ হল একেবারে লোককাহিনি।এই নীলাবতীর বিয়ে উপলক্ষে মহাদেবের – সঙ্গীরা যেমন সঙ সেজে আসেন, তেমন বিয়ের আসর আলোয় সাজানো হয়।নীলাবতীর ঘর তাই আলোকিত করতে বাতি জ্বালানো হয়। আর তারপর আজরা,অর্থাৎ ভূত- প্রেতদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হয়। পয়লা বৈশাখের ঠিক আগের রাত অর্থাৎ চলতি বঙ্গাব্দের শেষ রাতে দেশের কয়েক হাজার গ্রামে নীলাবতী ও শিবের বিবাহবাসরের বসে। সেই উৎসবে যেমন সঙ সেজে আসেন, তেমন বিয়ের আসর আলোয় সাজানো হয়। নীলাবতীর ঘর তাই আলোকিত করতে বাতি জ্বালানো হয়।তবে নববর্ষের উৎসবের চেয়ে একসময় দেশে চড়কের বা গাজনের জনপ্রিয় ছিল।কালীপ্রসন্ন সিংহের আমলে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ পড়লেই সেকালের সামাজিক উৎসবের চিত্র ফুটে ওঠে। সমাজের প্রান্তিক লোকদের উৎসবে জমিদার ও বাবু সম্প্রদায়ও আনন্দে একাকার হয়ে যেতেন। সামাজিক ভেদাভেদ মুছে যেত।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

১১৭টি ড্রোন দিয়ে রাশিয়ার বিমানঘাটিতে হামলা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রবিবার রাশিয়ার ইরকুটস্ক অঞ্চলের স্রেডনি জনবসতির কাছে অবস্থিত ওলেনিয়া বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে বড়সড়…

24 mins ago

ভারতের বিদেশনীতি!!

ভারতের আজন্ম বন্ধুরাষ্ট্র,কূটনৈতিক অভিধানে যাহাকে বলা হইবে স্ট্র্যাটিজিক পার্টনার সেই রাশিয়া সম্প্রতি পাকিস্তানের সহিত মউ…

33 mins ago

সিকিমে আটকে ১৫০০ পর্যটক!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-প্রবল বৃষ্টির জেরে বিপর্যস্ত সিকিম ও কালিম্পংয়ের একাংশ। টানা বৃষ্টির ফলে ধসের কারণে…

1 hour ago

লুধুয়া চা বাগানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে ইকো টুরিজম: সুশান্ত!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-বিকশিত ত্রিপুরার,বিকশিত পর্যটনের বৃহত্তম পরিসর গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছেন পর্যটনমন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী। উন্নয়নের…

2 hours ago

সেতু ভেঙে পড়ল রেললাইনের উপর, ছিটকে গেল চলন্ত ট্রেনের কামরা, বড় দুর্ঘটনা রাশিয়ায়!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ইউক্রেন সীমান্তঘেঁষা এলাকায় রাশিয়ার দু’টি পৃথক সেতু ভেঙে মৃত্যু হল অন্তত সাত জনের।…

7 hours ago

মৃত্যুদণ্ড হতে পারে হাসিনার,রবিতেই বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালে শুনানি!!

অনলাইন প্রতিনিধি:-বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রবিবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগের…

1 day ago