উচ্চশিক্ষার গতিভঙ্গ!!

 উচ্চশিক্ষার গতিভঙ্গ!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

গত জুলাইয়ে,তৃতীয় নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রথম তথা সর্বশেষ সংসদ অধিবেশনে, লোকসভায় এক প্রশ্নোত্তর পর্বে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান প্রদেয় একটি তথ্য এ দেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন জন্ম দিয়েছে। জুলাই মাসের ২৯ তারিখ দেশের শিক্ষামন্ত্রী জানান, চলতি বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার্থে ভারতের ৩ লক্ষ ৬০ হাজার ৫৮৮ জন শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন।তিনি আরও জানান,২০২৩ সালে আমাদের দেশ থেকে সর্বমোট প্রায় ৯ লক্ষ (৮,৯৪,৭৮৩জন) ছাত্রছাত্রী বিদেশে চলে গেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য।
ভারতবর্ষের উচ্চশিক্ষার মানচিত্রে এ কি যথেষ্ট উদ্বেগের চিত্র নয়?এর জন্য কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী নয় আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতির দুর্বলতা? মন্ত্রীমশাইয়ের যুক্তি অবশ্য একেবারেই ভিন্ন।তিনি মনে করেন,দেশের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে, কারণ ব্যাঙ্ক ঋণের সহজলভ্যতা, পূর্বতন সরকারের আমলে যা ছিল না।এদিকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক স্বীকৃত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল র‍্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক বা এনআইআরএফ-এর সমীক্ষায় প্রকাশ,দেশের নামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে (যেমন জওহরলাল নেহরু ইউনির্ভাসিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব হায়দ্রাবাদ, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)পূর্ণ সময়ের পিএইচডি গবেষকদের সংখ্যা ২০১৬- ১৭সালের তুলনায় ২০২২-২৩সালে উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে।যেমন জেএনইউ-এর মতো শীর্ষস্তরের উচ্চ শিক্ষায়তনে ২০১৬-১৭ সালে মোট ছাত্রছাত্রীর ৬২ শতাংশ ছিলেন গবেষক,যেখানে ২০২২- ২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশ।এই তথ্যে মোটামুটি স্পষ্ট যে, দেশে উচ্চমানের গবেষণার সুযোগ না থাকায় উচ্চশিক্ষা শেষে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই ফেলোশিপ নিয়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা- প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন।শিক্ষানীতির ব্যর্থতাই এই অবনমনের কারণ বলে মনে করছেন বিদ্বৎমহলের বড় অংশ।
এই অবস্থায় অন্যতম বৈকল্পিত সমাধানের পথ হিসাবে উচ্চশিক্ষায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ ঘটানো হয়েছে আমাদের দেশে।কয়েকদিন আগে কেন্দ্রীয় সরকারের তত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ব্রিটেনের সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে এই মর্মে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছে যাতে গুরুগ্রামে ওই ইউনিভার্সিটি তাদের একটি ক্যাম্পাস খুলতে পারে।এর আগে গুজরাটে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স চালু করেছিল দুইটি বিদেশি বিদ্যালয়।নতুন শিক্ষানীতির দৌলতে এই উদ্যোগ আরও প্রসারিত হবে হয়তো,তবে সমাজে বৈষম্য যে আরও দ্রুত বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
শিক্ষাক্ষেত্রে বেহাল অবস্থার অভিঘাত আমরা অনেক দিন ধরেই বর্তমান সমাজে প্রত্যক্ষ করছি।বিশেষ করে বিজ্ঞান শাখার বিভিন্ন স্তরে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান।এর ফলে বিজ্ঞান গবেষণায় এবং শিক্ষকতায় প্রয়োজনীয় মানবসম্পদের সঙ্কোচন অবশ্যম্ভাবী।অন্যদিকে, উচ্চশিক্ষায় এবং গবেষণায় মানবসম্পদের এই সঙ্কোচন কিসের ইঙ্গিত করে?এতে কি আমরা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় ক্রমশই পিছিয়ে যাব না? বিগত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে,আইআইটির সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই,কিন্তু সেই তুলনায় যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির বাজার তৈরি হয়নি,ফলত উচ্চশিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ কমে আসছে। উচ্চকিত কন্ঠে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বলে থাকেন যে, যুব শক্তি আমাদের দেশের বিরাট সম্পদ,অথচ তার সদর্থক প্রয়োগ হচ্ছে কই?বিশেষত বিজ্ঞান বিভাগে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও অঙ্কের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ যে হারে নিম্নগামী তা রীতিমতো উদ্বেগের।ফলত,এই বিষয়গুলিতে ভবিষ্যতে শিক্ষক এবং গবেষকদের সংখ্যা কমতে থাকবে।এক বিরাট অংশের উচ্চশিক্ষার্থী পড়ুয়ার সম্মুখেও অপেক্ষা করবে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এই সংকট মোচনে আশু প্রয়োজন শিক্ষা কমিশন গঠন করা,যা ভবিষ্যৎ দিশা নির্ধারণে পরামর্শ দেবে। দেশের শিক্ষার বেহাল পরিস্থিতি নিয়ে কথা উঠলে সমান্তালভাবে আসে দুর্নীতির কথা।কেন্দ্রীয় এবং বিভিন্ন রাজ্যস্তরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ভারতের শিক্ষাজগৎকে কার্যত অনিশ্চিত বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।কিছুকাল আগেও উচ্চশিক্ষার জন্য এ দেশের রীতিমতো আন্তর্জাতিক সুনাম ছিল, আজকের মলিন দশার জন্য একটি কারণ যদি হয় দুর্নীতি, তবে দ্বিতীয় সে কারণটি শিক্ষানীতি।জাতীয় শিক্ষানীতির বিবিধ আশ্চর্য-সংশোধনে ও প্রয়োগে উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে যে কত রকমের পঙ্কিল আবর্ত তৈরি করা হয়েছে,তা এখনও গুরুত্বসহকারে আলোচিত হচ্ছে না।কিছু তথ্য ও সমীক্ষার কেবল সেই হিমশৈলের চূড়া দৃশ্যমান। রাজনীতি নিয়ে এ দেশে অষ্টপ্রহর যত কচকচি চলে, তার কণামাত্র চর্চা যদি উচ্চশিক্ষার প্রচার-প্রসারে ত্বরান্বিত হয় তবে দেশের মঙ্গল,আগামী প্রজন্মের মঙ্গল।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.