ধর্মনগর, ডুকলি সিপিএম পার্টি অফিসে দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব, ভাঙচুর অভিযোগ শাসকের বিরুদ্ধে!!
উপত্যকার সংকট

পেহেলগাম কি প্রথম গ্রাম? এই ধরনের কথাও চালু রহিয়াছে। পাহাড়শ্রেণী শেষ হইয়া প্রথম জনপদ বা গ্রাম বা গাঁও। আবার কাশ্মিরী ভাষায় পহেলগাম শব্দের অর্থ হইলো পশুপালকদিগের জনপদ। কাশ্মীরি ভাষায় পশুপালককে বলা হয় ‘পেহেল আর ‘গাম’ মানে গ্রাম বা বসতি। প্রাচীন সময় হইতেই পেহেলগাম এক শান্ত, মনোরম চারণভূমি হিসাবে পরিচিতি পাইয়া আসিতেছে। পশুপালক পরিবারের বসতিতে পর্যটনের স্বার্থে অন্যন্য ঘরবাড়ি হইয়াছে ধীরে ধীরে। ২২ এপ্রিল মঙ্গলবারের পর হইতে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা স্থানটি বধ্যভূমি বলিয়া পরিচিত পাইতে শুরু করিয়াছে। শুরু হইয়াছে দোষারোপের খেলা। একটি নৃশংস, নিন্দনীয়, মানবতাবিরোধী অপরাধ যাহা কোনও শিক্ষা বা নৈতিকতার পক্ষে হইতে পারে না। ইহা আর বলিবার অপেক্ষা থাকে না যে হত্যাকাণ্ডের পশ্চাতে ইসলামি জঙ্গী সংগঠনের হাত রহিয়াছে। যদিও ইসলাম নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা সমর্থন করে না। আবার ইসলামী সন্ত্রাসী কথার অর্থ ইসলামের অনুসারী বা ধার্মিক এমন তো নহে। ধর্মাচরণ এবং ধর্ম রক্ষা এক বিষয় নহে। তাহা ছাড়া সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম নাই। পহেলগাঁওয়ে ঘটনা ঘটিয়া যাইবার পর যে বিষয়গুলিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলিয়া মনে করা হইয়াছে সেই সারণিতে প্রথমেই রহিয়াছে নিরাপত্তার বিষয়টি। ঘন জঙ্গলে ঘেরা এই চারণভূমিতে সমগ্র দেশের বিপুল সংখ্যক পর্যটকের বিশাল সমাগমে যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা কেন লওয়া হয় নাই? যাঁহারা জম্মু কাশ্মীরের ইতিহাস ও ভৌগোলিক বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত, তাঁহারা সকলেই জানিতেন পহেলগাম এলাকাটি বহু দশক ধরেই ভারতীয় নাগরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাহা হইলে ভারত সরকার কেন নিজ নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা লয় নাই? সর্বদলীয় সভায় বিরোধী সকল দলের তরফে এই প্রশ্ন আসিলে সরকার পক্ষ স্বীকার করিয়াছে, নিরাপত্তায় ঘাটতি ছিল। বিরোধীরা সরকারকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে কোনও পদক্ষেপের জন্য অনুমোদন এবং সমর্থন দিয়াছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় এই সংকটপূর্ণ সময়ে সকল সিদ্ধান্ত লইবে সরকার। সারা দেশ সেই সকল পদক্ষেপে সরকারের প্রতি অটল সমর্থন জুগাইয়া। যাইবে। জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভায় সদ্য সমাপ্ত অধিবেশনে জানানো হইয়াছিল,২০২৪ সালে কাশ্মীরে ৩৫ লক্ষ পর্যটক ভ্রমণে আসিয়াছিলেন। এর মধ্যে ৪৩ হাজার বিদেশি পর্যটক। জাতীয় সংবাদ মাধ্যম এই সংখ্যার নিরিখে দাবি করিয়াছিল কাশ্মীরে ‘আন্দোলনের যুগ শেষ’ হইয়াছে। কিন্তু আজ বলিতেই হয় যে পেহেলগামে নিরস্ত্র পর্যটকদের হত্যার দায় নিরাপত্তা সংস্থাগুলি এড়াইতে পারিবে না। সংবাদ মাধ্যমের বক্তব্যকে দায়হীন ছিল বলিয়া দাবি করিলেও, এই কথা স্বীকার করিতে হইবে পেহেলগাম নাম পর্যটন ক্ষেত্রটি সকল সময়েই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না। পহেলগামে প্রথম রক্তপাতের ঘটনা ঘটে ১৯৯৩ সালে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরের বছর ১৯৯৩ সালে পেহেলগামে অমরনাথ যাত্রায় তীর্থযাত্রীদের হামলা হয়। ইহার আগে পেহেলগাম ধর্মীয়, সামাজিক সহিষ্ণুতার এক দৃষ্টান্ত। মনোরম স্থানটি শ্রীনগর হইতে ৯৬ কিলোমিটার দূরে, অনন্তনাগ জেলায় অবস্থিত। অনন্তনাগ হইলো অগণিত প্রস্রবণের শহর। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, এই এলাকা ছিল ভগবান বিষ্ণুর আলয়। অমরনাথ মন্দির পেহেলগাম হইতে ৪৫ কিলোমিটার দূরে হিমালয়ের উচ্চ ভূমিতে অবস্থিত। প্রতি বৎসর শ্রাবণের পূর্ণিমায় হাজার হাজার হিন্দু ভক্ত অমরনাথ যাত্রায় অংশ নেন। অনন্তনাগে এক অসাধারণ ধর্মীয় সহাবস্থানের উদাহরণ রহিয়াছে, যাহা ভারতীয় সমাজ এবং ঐক্যের রূপক। হিন্দু মন্দির, মুসলমানদিগের মসজিদ ও শিখ গুরুদোয়ারা পাশাপাশি অবস্থান করিতেছে। ধর্মীয় সহাবস্থানের আর এক দৃষ্টান্ত হইল ‘বাবা দাউদ খাকি’র মসজিদ, যার আঙিনায় হিন্দুদিগের একটি মন্দিরও রহিয়াছে। একই অঞ্চলে রহিয়াছে আর এক জনশ্রুতিখ্যাত কাশ্মীরি সুফি সাধক রেশা মোল। এই সাধকের মাজারে মুসলমানের পাশাপাশি বহু হিন্দু ভক্তও আসিয়া থাকেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১৯৯২ সালে বাবরি ধ্বংসের পর এই অঞ্চলেরও ধর্মীয় সহনশীলতার আবহে চিড় ধরিয়া যায়। ১৯৯৩ সালের ১৫ আগষ্ট, এই এলাকায় অমরনাথ তীর্থযাত্রীদিগের ওপর হামলা আটজন নিহত হন। ১৯৯৪ সালে ৫ জন, ১৯৯৮ সালে ২০ জন, ২০০০সালে ৩২ জন, ২০০১ সালে ১৩ জন, ২০০২ সালে ৯ জন, ২০০৬ সালে ৫ জন, ২০১২ সালে ৭ জন ২০২২ সালে ৪ জন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে ১০ জন তীর্থযাত্রী নিহত হন। গত বছর, ১৯ মে শোপিয়া ও অনন্তনাগেও পর্যটকদিগের ওপর হামলা হইয়াছিল। তাই এই বৎসর পর্যটকদিগকে সতর্ক করা খুবই জরুরি ছিল। জরুরি ছিল নিরাপত্তা বিধানে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ। জানা যায় পেহেলগামের জঙ্গলে নিয়মিতভাবে সুরক্ষা বাহিনী তল্লাশি অভিযান চালাইয়া থাকে। ২০২৩-এর সেপ্টেম্বরে অনন্তনাগের কুকারনাগ পাহাড়ি জঙ্গলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযানে ব্যবহার হয়। তিনদিন ধরিয়া সংঘর্ষ চলে। সেনা ও সশস্ত্র বাহিনী আধিকারিকের মৃত্যুও ঘটে। যে জঙ্গী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জওয়ানরা প্রাণপণ লড়িয়া প্রাণপাত করিয়াছিল সেই গোষ্ঠীটিই কিন্তু পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করিল বলিয়া জানা যায়। পহেলগাঁওয়ে ২৬ পর্যটকের মৃত্যু উপত্যকায় পুলওয়ামা কাণ্ডের পর সর্ববৃহৎ হত্যাকাণ্ড। ২০১৯ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারী সিআরপিএফ কনভয়ের ওপর হামলার ঘটনার পর সেই বছর ২৬ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানে বিমান হামলা চালাইয়াছিল ভারত। এই দফায় ২২ এপ্রিল পেহেলগাম হামলার পর আবারও দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধোন্মাদনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নয়াদিল্লী ও ইসলামাবাদের মধ্যে এই সময়ে পারস্পরিক দূরত্ব ও কঠোরতা তৈরির প্রতিযোগিতা চলিতেছে। আর ভারতের প্রতিটি নাগরিক চাহিতেছেন নিরীহ পর্যটকদের ওপর হামলায় দোষীদের শাস্তি প্রদান।।