উলটপুরাণ!!

 উলটপুরাণ!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

সাম্প্রতিক ভারতের সেরা ব্র্যান্ড কোনটি? তর্কাতীত উত্তর, ধর্ম।ধর্মপ্রেমে মাতোয়ারা গোটা দেশ।আশা করা যায়, ভোটের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসবে ধর্মের তুঘলকি নিনাদ তত তীব্র হবে। তবে এই প্রেক্ষাপটে একেবারে চমৎকৃত এবং অবশ্যই ব্যতিক্রমী একটি প ঘটনার সাক্ষী থাকলো চৈতন্যধাম বাংলার নবদ্বীপে। রবিবার সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজ্যের প্রথম ‘নাস্তিক সম্মেলন’।গত বছর গঠিত নাস্তিক মঞ্চের উদ্যোগে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের তো বটেই, চল এমনকী আমাদের ত্রিপুরা, আসাম এবং বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিধিরা সেই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন।


নবদ্বীপ শুধু বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ভক্তি আন্দোলনের পীঠস্থানই নয়, একাধারে শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে এক নবজাগরণের সূচনাস্থল। চৈতন্যদেবের প্রভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং বিশেষ করে ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রচলিত ধ্যানধারণা ভেঙে চুরমার হয়েছিল।সেই চৈতন্যধামে ‘আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের দাবিকে অস্বীকার করি’, লেখাটি বিরাট ফ্ল্যাক্স ধরে নাস্তিক নাগরিকদের পদযাত্রাকে ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাষ্যের উলটপুরাণ বললে খুব ভুল হয় কি?বহু ইতিহাসের সাক্ষী নবদ্বীপ।সে পথ ধরেই একদা হেঁটেছেন বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর, কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তক রাজা বল্লাল সেন থেকে তুর্কি হানাদার বখতিয়ার খিলজি। সে পথেই কালীর রূপকল্পের সন্ধানে ফিরেছেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।নব্যন্যায়ের চর্চা করেছেন রঘুনাথ শিরোমণি, বুনো রামনাথ।সেই পথেই রবিবার সভা করেন, নাস্তিকতার স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন নাস্তিক মঞ্চের সদস্য-সদস্যারা।মঞ্চের নেতৃত্ব দাবি করেছেন,ধর্মযন্ত্রণা মুক্ত নাস্তিকতা ক্রমশ জনপ্রিয় বিশ্বদর্শন হয়ে উঠছে।বহু মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে জীবনের প্রতি একটি ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছেন।তদুপরি, ভারতেও বাড়ছে এদের সংখ্যা।নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মঞ্চের মাথারা বলেছেন,বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কৃতির পথে নাস্তিকতার প্রচার ও প্রসার। উল্লেখ্যনীয় বিষয় হলো, একই দিনে বাংলার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংস্থার ধাত্রীভূমি মহারাষ্ট্রেও।উল্লেখ থাক,দুই বছর আগে আগস্ট মাসে নাস্তিক সম্মেলনের ধাক্কায় পুণেতে স্থগিত রাখতে হয়েছিল রামনবমীর শোভাযাত্রা।দিন কতক আগে শাসক দলের এক সাংসদের মন্তব্য নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়। তিনি বলেছিলেন,দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের স্বীকৃত কর্তব্য ঈশ্বরবিশ্বাস প্রত্যয়িত করা।এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে এক ধর্মবিশ্বাসী অতি-প্রগলভতার প্রতিফলন।

‘ধর্মমোহ’ কবিতার প্রথম চরণে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’সামান্য এই দুই চরণের অন্তর্নিহিত অর্থ আমাদের অনুধাবন করতে হবে।তা না হলে ধর্মের নেতিবাচক দিক অর্থাৎ ধর্মান্ধতা এবং ধর্ম-অসহিষ্ণুতার জন্ম হবে।স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের শেখাতে চেয়েছিলেন, জগতে যত প্রাণ আছে, সকলে এক আত্মারই বহুরূপমাত্র।তিনি বলেছেন, আচারকেন্দ্রিক ধর্ম হলো ধর্মের গৌণরূপ।ধর্মের মুখ্যরূপ জীবপ্রেম, মানুষের সেবা।মন্দির, তীর্থ, পূজাপাঠের মধ্যে ধর্মের সার নেই, আছে নিজের অনুভূতি, উপলব্ধিতে।স্বামীজী মনে করতেন,প্রত্যেক ধর্মেরই অপর ধর্মগুলিকে স্বীকার করিয়া লওয়া আবশ্যক, ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় অপরের কোনও বিশেষ ধারণাকে ভিন্ন মনে করিয়া নিন্দা করা উচিত নয়।অনেক আগেই গৌতম বুদ্ধ থেকে মহাবীর জৈন, যিশু খ্রিস্ট ধর্মের আচার-সর্বস্বতাকে ত্যাগ করে ধর্মীয় চেতনাকে সকল মানুষের কল্যাণমুখী করে তুলতে চেয়েছিলেন। গীতাঞ্জলির একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন, আপন হৃদয়েই যেখানে মন্দিরের অধিষ্ঠান,সেখানে মন্দিরের আবেষ্টনে ঈশ্বর অনুসন্ধান অর্থহীন।বস্তুত, আবেগ আর মনন দুদিক থেকেই ধর্ম মানুষের বিরাট অবলম্বন,এখনও জাদুশক্তির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে,কখনও দার্শনিক চিন্তার প্রশস্ত পথ ধরে।সমাজতত্ত্ববিদদের অনেকেই ধর্মকে গুরুত্বপূর্ণ সমাজবন্ধন শাবে দেখেন। একই ধর্মীয় প্রতীকের অংশীদারি করতে গিয়ে অনেক মানুষ একটি ধর্মের ছাতার তলায় ঐক্যবদ্ধ হয়। ধর্মের সামাজিক জায়গাটায় ধর্মলালিত নৈতিকতারও বড় ভূমিকা রয়েছে।কী সেই নৈতিকতা? মানুষকে বোঝানো যে, মরা আর মারা ধর্মের প্রাথমি ফাংশন’ নয় বরং তা হলো বাঁচা আর বাঁচানো যার জন্য চাই বেদনশীলতা,ভালবাসা, ঔদার্য।এটাই ধর্মীয় নৈতিকতা।ধর্ম নিয়ে যারা কারবার করেন, তারা গোটা বিষয়টিকে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে ঢাকঢোল পিটিয়ে ধর্মান্ধতার পাল্টা এমন নাস্তিকতার মঞ্চ গড়ে তোলার হয়তো প্রয়োজন পড়ত না। দরকারই হতো না এ-হেন উলটপুরাণ বৃত্তান্তের। ধর্মান্ধতা এবং ধর্ম-অসহিষ্ণুতা যত বাড়বে,পাল্টা ভাষ্যও ক্রমে প্রকট হবে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.