‘এবার ফিরাও মোরে’!!

 ‘এবার ফিরাও মোরে’!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

এ বার ফিরাও মোরে,লয়ে যাও সংসারের তীরে হে কল্পনে, রঙ্গময়ী দুলায়ো না। সমীরে সমীরে তরঙ্গে তরঙ্গে আর, ভুলায়ো না মোহিনী মায়ায়। বিজন বিষাদঘন অন্তরের নিকুঞ্জচ্ছায়ায় রেখো না বসায়ে আর।’ মোহিনী কবির এই পঙ্ক্তিগুচ্ছ ভূস্বর্গের জনগণ পড়েছেন কি না জানা নেই, তবে কাশ্মীরের জনতার মনের অভিলাষ যে এটাই, ভোটযন্ত্রে বোতাম টিপে তারা তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, জঙ্গিদের বুলেট এবং তার প্রতিস্পর্ধী সেনাপ্রহরায় বেষ্টিত উপদ্রুত ভূস্বর্গ নয়, বরং সুষ্ঠু গণতন্ত্রেই তারা আস্থাশীল। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, যতই তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিষ্পেষণের বিপুল আয়োজন থাকুক না কেন, যতই তারা দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ুন না কেন, কেবল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে তাদের ভাগ্য তারা নিজেরাই গড়তে পারেন। ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ঘটিয়ে, ডি-লিমিটেশন প্রয়োগ করে, কাশ্মীর ও জম্মুর তুলনামূলক জনসংখ্যাভিত্তিক আসন বাড়িয়ে কমিয়ে যে লক্ষ্য সাধনের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, জনতাই তাকে ব্যর্থতায় পর্যবষিত করেছে। জম্মুতে বিজেপির ভোট অনেকখানি বাড়লেও, কাশ্মীরে ভোট ভাগ না হয়ে প্রধান বিরোধী পক্ষের ঝুলিতে পড়েছে, আর তাতেই উল্টে গেছে শাসকদলের পাশার ছক। গত ১৮ ও ২৫ সেপ্টেম্বর এবং ১ অক্টোবর- তিন পর্বের ভোটে কাশ্মীর উপত্যকার মানুষ যেভাবে দশ বছর পর ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেছেন, তাতে স্পষ্ট, স্বদেশের মাটিতে অষ্টপ্রহর সচিত্র পরিচয় পত্র বুকে আগলে আতঙ্কের জীবন নয় দেশের বাকি অংশের মানুষের মতো তারাও একটি স্বশাসিত রাজ্যে বাস করতে চান, যেমনটা তারা বাস করেছেন দীর্ঘকাল। লক্ষ্মীপুজোর দিন নতুন মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েই ওমর আবদুল্লা জানিনে দিয়েছেন, তার প্রথম কাজই হতে চলেছে জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য কেন্দ্রশাসি অঞ্চলের পরিচয় সরিয়ে রাজ্য পরিচয় ফিরিয়ে আনা। এর পরদিন সুপ্রিম কোর্টে জম্মু কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে ফের মামল দায়ের করে জরুরি ভিত্তিতে তা শুনানির আর্জি জানানো হয়েছে। তাতে সম্মতি দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় স্বয়ং। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিলের ছয় বছর পরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে জয় লাভের পর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন ন্যাশনাল কনফারেন্স দলের নেতা ওমর আবদুল্লা। নতুন সরকার নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি ছয় বছরেরও বেশি সময় পরে রাষ্ট্রপতি শাসনের অবসান হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরে। নতুন সরকার শপথগ্রহণের তিনদিন আগেই কেন্দ্রের তরফে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর স্বাক্ষরিত বিবৃতি সহকারে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটিতে রাষ্ট্রপতি শাসন
প্রত্যাহার করার কথা ঘোষিত হয়। এর আগে জম্মু কাশ্মীর রাজ্যে শেষ নির্বাচন হয় ২০১৪ সালে। বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে সরকার গঠন করেছিল মেহবুবা মুফতির পার্টি পিডিপি।

২০১৮ সালে দুই দলের জোট ভেঙে যায়। পতন হয় সরকারের। সে বছরের ১৯ জুন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় জম্মু ও কাশ্মীরে। ঠিক ছয় বছর আগে অক্টোবরের শেষদিনটি অতিক্রান্তের পরেই ভারতের মানচিত্রে যুক্ত হয় আরও দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। জম্মু কাশ্মীর ও লাদাখ। এই সূত্রে সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদ বিলোপ করা হয়। ওই সিদ্ধান্ত ঘোষণার অব্যবহিত পরেই কাশ্মীরকে কার্যত মুড়ে দেওয়া হয় সেনাপ্রহরায়। বিভিন্ন জায়গায় ১৪৪ ধারা ও কাফু জারি করা হয়। স্কুল-কলেজ, অফিস, দোকানপাট, বাজার, ব্যাঙ্ক, পেট্রোল পাম্প বন্ধ হয়ে যায়। রাজনৈতিক নেতাদের অন্তরিন করে রাখা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইলের ব্যবহার ও ইন্টারনেট সংযোগ। এতদসত্ত্বেও কাশ্মীরে গুলীর শব্দ থামানো যায়নি। বন্ধ করা যায়নি জঙ্গি অনুপ্রবেশের চেষ্টা। স্তব্ধ হয়নি হতাহতের সংখ্যা। উপত্যকায় বৃহৎ কোনও লগ্নির সংবাদও আসেনি।
মানুষই ইতিহাস গড়ে, বুঝিয়েছে কাশ্মীরের ফলাফল। দাঁত ফোটাতে পারেননি সেই নির্দল প্রার্থীরা যারা ভিন্ন পরিচয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে বিজেপিরই সুবিধা তৈরি করতে ব্যস্ত ছিলেন। এহ বাহ্য, মোক্ষম বার্তা পেয়েছেন বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও, যারা কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতার কথা বলে এতদিন নিজেদের সমর্থন তৈরি করেছিলেন। ভারতবিরোধিতা ও ভোটবিরুদ্ধতার কড়া আক্রমণাত্মক রাজনীতি করে অকস্মাৎ তারা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। এই ভোট তাদের অধিকাংশের দুয়ারে তালা এঁটে দিয়েছে। ভূস্বর্গের মানুষের প্রত্যাশা একটাই, যা এই ফল থেকে উৎসারিত- ‘হয়তো ঘুচিবে দুঃখনিশা, তৃপ্ত হবে এক প্রেমে জীবনের সর্বপ্রেমতৃষা’।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.