কবর খুঁড়িও না
বারাণসীর জ্ঞানবাপীর মসজিদে সমীক্ষার কাজ ৪৮ ঘন্টা স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সোমবার এই নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। এর ফলে বুধবার, অর্থাৎ ২৬ জুলাই বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত জ্ঞানবাপী মসজিদে সমীক্ষার কোনও কাজ করতে পারবে না ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (আর্কিওলজিক্যালল সার্ভে বা আইএসআই)।ভারতের সলিসিটর জেনারেল শীর্ষ আদালতকে এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, আইএসআই সমীক্ষায় শুধু ছবি তুলছে এবং কিছু মাপজোপ করা হচ্ছে।একটি ইটও সেখান থেকে সরানো হচ্ছে না অথবা ইট সরানোর কোন পরিকল্পনাও নেই।উভয় পক্ষের শুনানিরপরে প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, বারাণসীর জেলা বিচারকের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে যথাযথ প্রক্রিয়া চালাতে বা সংবিধানের ২২৭ অনুচ্ছেদ বলে বিবেচনার স্বার্থে আবেদনকারীদের হাইকোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। সলিসিটর জেনারেলের ‘শুধু ছবি তোলা আর মাপজোপ করা’র আশ্বাস সত্বেও, আবেদনকারী মসজিদ কমিটিকে উচ্চ আদালতে যাওয়ার পথ করে দিতে সুপ্রিম কোর্টের এই স্থগিতাদেশ সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।জ্ঞানবাপী মসজিদে সমীক্ষার কাজ শুরু করতে নির্দেশ দিয়েছিল বারাণসী আদালত।সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় ‘অঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া (জ্ঞানবাপী) মসজিদ কমিটি”। তবে বারাণসী জেলা আদালতের নির্দেশ পেয়েই সমীক্ষা শুরু করতে যে অতিসক্রিয়তা দেখানো হয়, এক কথায় তা বিস্ময়কর। শুক্রবার জেলা আদালতের আদেশ, তারপর শনি ও রবিবার ছুটি, এবং সোমবার সকাল সাতটা থেকে আইএসআইয়ের তিরিশ সদস্যের সমীক্ষক দলের ‘কাজ’ শুরু করে দেওয়া! অথচ জেলা আদালতের আদেশকে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়ে অন্তত একদিনের জন্য মসজিদ কমিটি সমীক্ষা স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছিল। তাদের সেই আর্জি জেলা আদালত নাকচ করে দেয়।কোনও বিষয় ন্যায়ালয়ে পৌঁছলে সাংবিধানিক ও আইনগত বিধানের আলোকে বিবেচনা করে মহামান্য আদালত যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, যেকোনও মূল্যে তার সম্মান প্রদর্শন সমাজ এবং সরকারের কর্তব্য। কিন্তু একটি দেশ ও সমাজ হিসাবে শুধু আমাদের অগ্রাধিকার নির্ধারণের অধিকারই নয়, একই সঙ্গে আমাদের প্রগতি সাপেক্ষে দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করাও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়ন ও প্রগতির পথে ক্রমে অগ্রসর হয়েছে এবং হয়ে চলেছে এই দেশ। কোনও অর্থেই উন্নয়নের সেই গতিধারার গতিমুখ পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত নয়। মূল অগ্রাধিকার এটাই যে, দেশকে এই ধারা বজায় রাখতে হবে এবং আগামী দিনে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যতটা সম্ভব উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে।কোনও প্রগতিশীল দেশেরই হৃদয় খুঁড়ে বেদনা এবং কবর খুঁড়ে মৃতদের জাগিয়ে তোলা বাঞ্ছনীয় নয়। অতীতের ভূতের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে বরং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের উচিত পারস্পরিক হানহানি থেকে বিরত থেকে, বরং অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের কর্তব্যের প্রতি মনোনিবেশ করা।উল্লেখ্য, গত জুন মাসের তিন তারিখ নাগপুরের এক সভায় জ্ঞানবাপী বিতর্কে প্রথমবার মুখ খুলে সরসংঘচালক মোহন ভাগবত অত্যন্ত গঠনমূলক একটি মন্তব্য করে বলেছিলেন, প্রতিটি মসজিদে শিবলিঙ্গ খোঁজা অর্থহীন, মসজিদ-মন্দির বিতর্কে পারস্পরিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাস্তা খোঁজা জরুরি।
বাবরি কাণ্ডের আগে সমচারিত্রিক আগুন বাকি ভারতেও ছড়াতে পারে আঁচ করেই তৎকালীন নরসিংহ রাও সরকার ১৯৯১ সালে প্লেসেস অব ওয়রশিপ অ্যাক্ট নামে একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ী, স্বাধীনতার সময় দেশের যেকোনও ধর্মস্থানের যে চরিত্র ছিল, তা পরিবর্তন করা বেআইনি। অর্থাৎ, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট যে ধর্মস্থানগুলি মন্দির হিসেবে গণ্য হত, সেগুলিকে মসজিদ বা গির্জায় পরিবর্তন করা যায় না, যেখানে মসজিদ ছিল, তাকেও কোনভাবে মন্দিরে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ফলত,এই আইনের ফাঁকফোকর না খুঁজে পরমত সহিষ্ণুতার চেতনায় ধর্মীয় স্থানের অতীত সংক্রান্ত বিতর্ককে ‘অতীত’ হিসাবে বিবেচনা করাই শ্রেয়।