কার লাভ কার ক্ষতি!!

জন্মলগ্ন হইতে যে সংঘাত সংঘর্ষের সূচনা হইয়াছিল-দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই পর্বের তুমুল সংঘর্ষের এইবার বিরতি পর্ব চলিতেছে। দুই দেশের সেনারা কথা বলিয়াছে। ভবিষ্যতেও বলিবে। এই পর্যন্ত ঠিকই আছে।কিন্তু এমন নহে যে কথা বা আলোচনা দুই দেশের সেনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিবে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রনায়কেরা সেই আলোচনায় যোগ দিবে এবং যে কোনও ভারতবাসী মাত্রেই জ্ঞাত রহিয়াছেন এই আলোচনা শেষ পর্যন্ত কাশ্মীর ইস্যুতে আসিয়া থামিবে এবং আরও একদফা অসমাপ্ত, অসফল থাকিয়া যাইবে।এই ভাবেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিবে। দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদি যেইহেতু কাশ্মীর বা পাকিস্তান ইস্যুতে পূর্বজদের তুলনায় নিজেকে কিছু পৃথক বলিয়া দাবি করিতে পারিতেছেন না তাই কাশ্মীর লইয়া ব্যতিক্রম পরিণতির ভাবনা না ভাবিলেই ভাল।
চারদিন রাত্রব্যাপী সংঘর্ষের পর ১০ মে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হইয়াছে ভারত এবং পাকিস্তান।আলোচনার প্রস্তুতিতে দুই দেশই নিজ নিজ কাড়া নাকাড়া বাজাইয়া নিজের জয়গাথা গাহিতেছে। কিন্তু চারদিনের এই সংঘর্ষে বিজয় কাহার হইয়াছে এই লইয়া নানান ধরনের বিশ্লেষণ চলিতেছে। দুই দেশের সরকারী পরিসরের বাহিরের যে বিশ্লেষণ তাহা শুনিবার মতন। সেই সকল বিশ্লেষকরা বলিতেছেন, এই লড়াইয়ে কেউ পুরোপুরি জয়ী হইয়াছে কিনা, তাহা বলা কঠিন। তবে দুই পক্ষই নিজ নিজ বিজয় দাকি করিয়াছে। ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে বন্দুকধারী সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটকের নৃশংস মৃত্যুর পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উত্তপ্ত হইয়া উঠে। অনামি এক সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘দ্যা রেজিস্ট্যাস ফ্রন্ট'(টিআরএফ) ওই হামলার দায় স্বীকার করিয়াছিল। ভারতের দাবি,এই গোষ্ঠী পাকিস্তান-সমর্থিত।তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ নাকচ করিয়া দিলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশোধ লওয়ার হুমকি দেন।দুই প্রতিবেশী একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক পদক্ষেপ লইতে থাকে এবং উত্তেজনা সামরিক সংঘাতের রূপ লয়।৭মে সকালে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে চারটি স্থানে ‘জঙ্গিঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। পরের দিনগুলিতে দুই দেশই একে অপরের ভূখণ্ডে ড্রোন হামলা চালায় এবং স্বাভাবিক নিয়মে একে অপরকে হামলার জন্য দায়ী করিতে থাকে।১০ মে উভয় দেশ একে অন্যের সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাইবার পর উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। ভারত শুরুতে পাকিস্তানের তিনটি বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করিয়া হামলা চালায়, যাহার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল রাওয়ালপিণ্ডি। এই শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের অবস্থান রহিয়াছে বিধায় এই শহরকে সামরিক ঘাঁটির শহর (গ্যারিসন সিটি) হিসাবে গণ্য করা হইয়া থাকে। ইহার বাহিরে ভারত আরও কিছু পাকিস্তানি ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনা ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং জম্মু কাশ্মীরে অবস্থিত সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করিয়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা ভারতের অন্তত চারটি সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হানে। যুদ্ধবিরতির পর উভয় দেশই নিজেদের ‘জয়ী’ দাবি করিয়া নানান ‘প্রমাণ’ উপস্থাপন করে। এক সপ্তাহ আগে,সোমবার ভারত ‘পাকিস্তানের বরিষ্ঠ সেনাকর্তারা ফোনে কথা বলেন এবং যুদ্ধবিরতি মানিয়া চলার অঙ্গীকার করেন।
পরিস্থিতি যখন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে যাইতেছে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন এবং দাবি করেন, এই যুদ্ধবিরতি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হইয়াছে। পাকিস্তান এই উদ্যোগের প্রশংসা করিলেও ভারত বলিয়াছে বাহিরের কাহারও হস্তক্ষেপ ছাড়াই যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত দুই দেশের মধ্যে হইয়াছে। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প উপর্যুপরি বলিতেছেন, তাহার মধ্যস্থতাতেই বিরতি চলিতেছে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আগেকার চারটি যুদ্ধের তিনটি হইয়াছিল কাশ্মীর ইস্যু লইয়া। এইবারকার সামরিক সংঘাতও মূলত কাশ্মীরকেন্দ্রিক। দুই দেশের দীর্ঘদিনের বিরোধ হইতেই উদ্ভূত। পাকিস্তান ও ভারত কাশ্মীরের দুইটি অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখিয়াছে। আবার দুইটি সরু অংশচিনও নিয়ন্ত্রণ করিতেছে। ভারত-সম্পূর্ণ কাশ্মীর নিজের অংশ হিসাবে দাবি করে। অন্যদিকে পাকিস্তানও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর রাজ্যটিকে নিজেদের বলিয়া দাবি করিয়া আসিতেছে। আবার মিত্র চিন যে অংশ নিয়ন্ত্রণ, করিতেছে, তাহা লইয়া পাকিস্তানকে কখনই কিছু বলিতে দেখা যায় না। ভারতের বরাবরের অবস্থান, কাশ্মীর দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়। ইহাতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু এইবার ভারতকে তৃতীয় দেশের মধ্যস্থতা মানিয়া লইতে হইতেছে, যাহা একটি চাপের বিষয় ও হজমঅযোগ্য। কূটনৈতিক বিশ্লেষক সুধা রামচন্দ্রন বলিয়াছেন, ভারতের অভ্যন্তরে মোদি সরকারের জাতীয়তাবাদী সমর্থকেরা পাকিস্তানের সহিত সংঘাতে উজ্জীবিত হইলেও যুদ্ধবিরতিতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিয়াছে।
১৯৭১সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বছরে ভারত-পাকিস্তানও যুদ্ধে জড়াইয়া পড়ে। এই সময় নয়াদিল্লী ও ইসলামাবাদ চুক্তিকে স্বাক্ষর করে, যাহা সিমলা চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে তাহারা একমত হইয়াছিল, পারস্পরিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ ও দ্বিপাক্ষিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা হইবে। তৃতীয় কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপ চলিবে না। তবে পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুতে জাতিসংঘের প্রস্তাবের কথা তুলিয়া ধরিয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ দাবি করিয়া আসিতেছে।পহেলগাঁও কাণ্ডে।ইসলামাবাদ হামলায় জড়িত থাকিবার অভিযোগ অস্বীকার করিয়া নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানাইতেছে। ফলে কাশ্মীর বা ভারত-পাক ইস্যু যদি ত্রিপাক্ষিক হইয়াও যায় তাহা হইলে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করিবার দায় ক্রমশ পাকিস্তানের ওপরই বর্তাইতেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রাম্প বলিয়াছেন, তিনি দুই দেশের সহিত কাজ করিতে চান। তিনি চান ভারত ও পাকিস্তানের ‘হাজার বছরের বিতর্ক শেষ হোক। আল-জাজিরার খবর অনুযায়ী, ইসলামাবাদ আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশের মধ্যস্থতাকে স্বাগত জানাইয়াছে এবং যুদ্ধবিরতিকে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করিতেছে।
এই কথা সত্য যে ভারতকে তৃতীয় শক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধবিরতি মানিয়া লইতে হইতেছে। অর্থাৎ সংঘাত নিজের শর্তে কিংবা দ্বিপাক্ষিক ভাবে শেষ করিতে পারে নাই। ইহাতে আপাত প্রতীয়মান হইতেছে এইবারকার সংঘাত পাকিস্তানকে সুযোগ দিয়াছ কাশ্মীর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক ভাবে তুলিয়া ধরিবার, যাহা তাহাদের বহুদিনের কৌশলগত লক্ষ্য। লণ্ডনের কিংস কলেজের বরিষ্ঠ অধ্যাপক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ আল-জাজিরায় তার এই অভিমতেও এই কথা বলিয়াছেন। অপর দিকে দ্য ডিপ্লোম্যাট সাময়িকীর দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক সুধা রামচন্দ্রন বলিয়াছেন, মোদি সরকার এই সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ভারতের জাতীয়তাবাদী ও কট্টরপন্থী সমর্থকদের আরও দৃঢ়ভাবে পাশে পাইয়াছিলেন তবে যুদ্ধবিরতির কারণে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমর্থনও তাহাকে হারাইতে হইতে পারে। কট্টরপন্থীরা যুদ্ধবিরতিকে ভালোভাবে গ্রহণ করে নাই। বিশ্লেষকদের মতে, এই সংঘাতে ভারতও কৌশলগতভাবে কিছু অর্জন করিতে পারিয়াছে। পহেলগাঁও হামলার পর ভারত আন্তর্জাতিক মহলে আবারও পাকিস্তানের মাটিতে সক্রিয় ‘জঙ্গিগোষ্ঠী’ বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে টানিয়া আনিয়াছে। পাকিস্তান সন্ত্রাসের অভিযোগ অস্বীকার করিয়া নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করিতেছে বটে তবুও আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের ওপর সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণের চাপ বাড়িতেছে।