কাশ্মীরপঞ্জীর সিমলা চুক্তি!!

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

পহেলগাঁওয়ে হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে তা চরম আকার লইতেছে।দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ লইতেছে। ঘটনার পর দ্রুত কতকগুলি সিদ্ধান্ত জানায় নয়াদিল্লী।এই তালিকায় সিন্ধু নদীর জলবন্টন চুক্তি স্থগিত, প্রধান সীমান্ত পথ আটারি বন্ধ করিয়া দেওয়া, পাকিস্তানি নাগরিকের জন্য ভিসা বন্ধ ও বাতিল সহ কূটনীতিক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত। জবাবে পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে অনুরূপ পদক্ষেপ লয়। জানানো হইয়াছে, পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করিতে পারিবে না ভারত। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিও স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান। বস্তুত নয়াদিল্লী সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিতের পরপরই পাকিস্তানের তরফে সিমলা চুক্তি স্থগিতের দাবি ওঠে। পাকিস্তান দাবি করিতেছে, ভারত যদি বিশ্বব্যাঙ্কের অধীন ‘সিন্ধু জলচুক্তি’-কে বিদায় জানাইতে চাহে, তবে পাকিস্তানেরও সিমলা চুক্তি হইতে সরিয়া আসা উচিত, যে চুক্তির মধ্যস্থতায় কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা অন্তর্ভুক্ত নাই। অবশ্য এই লইয়া পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিতর্কও রহিয়াছে। তবে পাকিস্তানের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বলিতেছেন, পাকিস্তানকে সিমলা চুক্তি হইতে বাহির হইয়া আসা উচিত, অন্তত কাশ্মীর ইস্যুতে।
বস্তুত, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যেকার সকল বিবাদ আসিয়া কাশ্মীরে বরফ হইয়া জমিয়া যায়।সেই বরফ আর গলিতেছে না কোনও দিনই। ১৯৪৭ সালের পর হইতে এই ইতিহাস কম বিশাল নহে। কাশ্মীরের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলি যদি বলা হয় তাহা হইলে সংক্ষেপে ১৮৪৬ সালে কাশ্মীর রাজ্য গঠিত হয়। ১৯৪৭-৪৮ সালে পাকিস্তানি নৃগোষ্ঠী বাহিনীর হামলার পর কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সঙ্গে অধিগ্রহণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীর ভাগ হয়। ১৯৬২ সালে আকসাই চিন সীমান্ত লইয়া চিন ভারতের যুদ্ধ, ভারত পরাজিত হয়। ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয়বার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, এই যুদ্ধও যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়া শেষ হয়। সত্তরের দশকে কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে এবং জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার লক্ষ্য ভারত ও পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরকে পুনরায় একত্র করিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন।
১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ইন্দিয়া গান্ধী এবং জেনারেল ভুট্টোর মধ্যে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর নিজ নিজ অধিগৃহীত ভূমি বরাবরে ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণরেখা চূড়ান্ত করিয়া আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে একমত হয়। ১৯৮০-১৯৯০ এই সময়ে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে উপত্যকায় সশস্ত্র আন্দোলন, গণবিক্ষোভ ও পাকিস্তান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান মটে।হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ।পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ভারতের অধীন কারগিল অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করিলে ভারত ও পাকিস্তান আবার স্বল্পমেয়াদি সংঘর্ষে জড়াইয়া পড়ে।
২০০৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান ছয় দশকের ইতিহাসে প্রথমবার নিয়ন্ত্রণরেখা পারাপারের বাণিজ্য রুট চালু করে। ২০১০ সালে কাশ্মীরে ভারতবিরোধী বিক্ষোভ চূড়ান্ত আকার নিলে শতাধিক নিহত হন। ২০১৫ সাল ছিল কাশ্মীরের রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ, জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচনে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি প্রথমবারের মতন এই অঞ্চলে বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। আঞ্চলিক দল মুসলিম পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টিকে সঙ্গে লইয়া জোট সরকার গঠন করে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে পুলওয়ামায় রক্ষীবাহিনীর বহরে আত্মঘাতী হামলা হইলে অন্তত ৪০ জন জওয়ান নিহত হয়। এই বৎসরের অগাস্ট মাসে ভারত সরকার জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করিয়া দেয়, জম্মু কাশ্মীর রাজ্য দুইভাগে বিভক্ত করিয়া কেন্দ্রশাসিত দুইটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। দীর্ঘদিন নীরবতার পর ঘটিল পেলেহগাঁওয়ের ভয়াবহ নৃশংসতা। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারত সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করিবার সিদ্ধান্ত জানায়। পাল্টা জবাবে ইসলামাবাদ সিমলা চুক্তি হইতে বাহির হইয়া আসিবার সিদ্ধান্ত জানাইয়া দেয়। বস্তুত সিমলা চুক্তি হইয়াছিল কাশ্মীর সংক্রান্ত বিষয়ে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সিমলা চুক্তি পাকিস্তানকে কাশ্মীর ইস্যুর আন্তর্জাতিকীকরণ বিরত করিয়া রাখে নাই। বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুকে তৃতীয় দেশের মধ্যস্থতায় কিংবা আন্তর্জাতিক ফোরামের সম্মুখে লইয়া যাইতে চাহিয়াছে। তবে এই সকল ক্ষেত্রে সিমলা চুক্তি ওই চুক্তি তাহাদের উদ্যোগকে বিফল করিয়াছে। তবে পাকিস্তান যদি দ্বিপাক্ষিক সিমলা চুক্তি হইতে বাহির হইয়া যায় তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এবং ফোরামে কাশ্মীর ইস্যু লইয়া জোরগলায় প্রপাগান্ডা করিতে পারিবে, সামনে কোনও বাধা থাকিবে না।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতীয় সেনার কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং বাংলাদেশের জন্মের পরের বছরেই সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর হইয়াছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যেকার শত্রুতার অবসানে গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া দাবি করা হইয়াছিল। মাস ছয় আগেই পাক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ করিয়াছে, ৪৫ হাজার পাক সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনী সমেত ৭৩ হাজার যুদ্ধবন্দি সেই সময়েও ভারতের কারাগারে। এই পটভূমিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো হিমাচল প্রদেশের সিমলায় বৈঠকে বসিয়াছিলেন। বৈঠকের সেই সমঝোতার নামকরণ হইয়াছিল সিমলা চুক্তি। চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যেকার নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) গঠিত হয়। দুই পক্ষই এই নিয়ন্ত্রণরেখাকে সম্মান জানাইতে রাজি হয়। উভয়েই সম্মত হইয়াছিল দ্বিপাক্ষিক কথা ব্যতীত কেহই একতরফা সিদ্ধান্ত লইবে না। নিয়ন্ত্রণরেখাকে স্কেল হিসাবে বিবেচনা করিয়া উভয়ে একে অপরের ভূখণ্ড হইতে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হইয়াছিল। কিন্তু বাস্তবে দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণরেখা অমান্য করিবার অভিযোগ তুলিয়া আসিয়াছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করিতেছেন পাকিস্তানের এই সিদ্ধান্ত কাশ্মীর ইস্যুতে বড় সিদ্ধান্ত লইতে ভারতকে সাহায্য করিবে। বাস্তবে পাকিস্তান অনেক আগেই সিমলা চুক্তি হইতে সরিয়া আসিয়াছে। পাকিস্তান কখনওই এই চুক্তিতে অটল থাকে নাই। পাকিস্তান যদি চুক্তি মানিয়া লইতো, তাহা হইলে তাহারা কারগিলের যুদ্ধ করিত না। ভারতীয় কটনতিক বিশেষজ্ঞরা বারংবার নানান ফোরামে উল্লেখ করিয়াছেন,প্রতিদিন আমরা সীমান্তের পার হইতে গুলী চালাই না এবং সন্ত্রাসীদের ভারতীয় ভূখণ্ডে নিরাপদ আশ্রয়ও দেই না। অর্থাৎ, পাকিস্তান এতদিন ধরিয়া মুখে না বলিলেও সিমলা চুক্তি তাহারা কোনদিনই মানিয়া লয় নাই। তাই পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান যদি মৃত চুক্তির সৎকার করতে চাহে তাহা হইলে নয়াদিল্লীর কোনও লোকসান নাই বরং কাশ্মীর লইয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চুক্তি খেলাপের অভিযোগ তোলা যাইবে।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

সিকিমে ধ্বস পড়ে বন্দি ১৮০০ পর্যটক!

অনলাইন প্রতিনিধি :-সিকিমের ৬ থেকে ৭টি জায়গায় ব্যাপক ধ্বস নামে। ৬০০ জন পর্যটক এখনও লাচেনে…

2 hours ago

গুজরাতে আটক হাজারের অধিক বাংলাদেশি, মিলল পশ্চিমবঙ্গের জাল নথি !!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যে অবৈধভাবে বসবাসকারী লোকদের হঠাতে ব্যাপক অভিযানে নেমেছে গুজরাত পুলিশ ৷ রাতভর অভিযান…

2 hours ago

গাজায় ইসরায়েলি হামলা নিহত ৫৬!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি হামলায় ২৪ ঘন্টায় আরও ৫৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন…

3 hours ago

বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ভারী বৃষ্টির কারণে ভুবনেশ্বরে জরুরি অবতরণ কলকাতাগামী ৪ বিমান, দুর্ভোগ চরমে!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-খারাপ আবহাওয়ার জেরে ওড়িশা বিমানবন্দরেই জরুরি অবতরণ করানো হয় কলকাতাগামী ৪ টি বিমানকে।…

6 hours ago

জল বন্ধ হলেই যুদ্ধ! হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের মন্ত্রীর!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-১৩০টি ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের দিকে তাক করে রেখেছে পাকিস্তান। সে দেশের মন্ত্রী হানিফ আব্বাসি…

9 hours ago

জিবিতে ফের রোগীর মৃত্যু প্রশ্নের মুখে চিকিৎসা ব্যবস্থা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যের প্রধান সরকারী হাসপাতাল জিবিতে চিকিৎসার গাফিলতি ও অবহেলাতে আবার রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ…

9 hours ago