কৃষকের লাভ-ক্ষতি!!

 কৃষকের লাভ-ক্ষতি!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

দ্বিচারিতা শব্দের আভিধানিক অর্থ স্ববিরোধী ক্রিয়া, অর্থাৎ নিজের কথা ও আচরণের পারস্পরিক বিরোধিতা। তৃতীয় দফায় নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বে কেন্দ্রীয় সরকার এ দেশের কৃষক সমাজের জন্য নির্বাচনের আগে যে বার্তাটি দিয়েছিল আর কাজে যা করে দেখাল, তাকে দ্বিচারিতা বললে অত্যুক্তি হয় না।
তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদি প্রথম যে ফাইলটিতে ক্যামেরার সামনে স্বাক্ষর করেন,সেটি পিএম কিসান নিধি যোজনার।তৃতীয় দফায় অভিষেকের দিনই ওই দৃশ্যপট নির্মাণের মাধ্যমে তিনি বার্তা দিতে চান, কৃষকদের হতাশা দূর করাই তার এ বারের অগ্রাধিকার। ফাইলে স্বাক্ষর করার পর মোদি বলেন,’আমাদের সরকার কৃষকদের কল্যাণে দায়বদ্ধ।দায়িত্ব নিয়েই কৃষকদের কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত ফাইলে স্বাক্ষর করলাম।আগামী দিনে আমি কৃষক এবং দেশের কৃষিক্ষেত্রের জন্য আরও বেশি কাজ করে যেতে চাই।’ এর অব্যবহিত পরে ধানের নূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) বাড়ায় এনডিএ সরকার।এতে চাষির মুখের হাসি চওড়া হওয়ার বদলে বরং কপালের ভাঁজ আরও গভীর হয়েছে।কৃষক সংগঠনগুলির অনুযোগ, কুইন্টালে মাত্র একশো সতেরো টাকা এমএসপি, অর্থাৎ পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি চাষির সঙ্গে আদতে এক নিষ্ঠুর পরিহাস।প্রতি কুইন্টাল ধানে অন্তত ৩১০০ টাকা না পেলে চাষির লাভ থাকে না, সেখানে সরকার মাত্র ২৩০০ টাকা সহায়ক মূল্য ঘোষণা করেছে। চাষিদের একাংশ স্বামীনাথন কমিটির নির্ধারিত রীতি মেনে এমএসপি নির্ধারণ করার দাবি পেশ করেছে। সরকার সে বিষয়ে এখনও নীরব। কীসের ভিত্তিতে বর্ধিত এমএসপি,সেটিও সরকার জানায়নি।সত্য এই যে, কৃষক আন্দোলনের দাবি মেনে এমএসপি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আইন পাস করার পথে হাঁটছে না কেন্দ্র। পাশাপাশি আছে কিছু চিরায়ত সমস্যা। যেমন, প্রতি মরশুমে অনেকগুলি ফসলের এমএসপি ঘোষণা করে সরকার, অথচ অধিকাংশেরই সরকারী ক্রয়ের ব্যবস্থা নেই। ফলে ডাল, সর্ষে বা ভুট্টার মতো ফসল চাষি এমএসপিতে বিক্রি করতে পারেন না, আর সরকারী ক্রয় নেই বলে বাজারের দামের উপর এমএসপির কোন প্রভাবও পড়ে না। আবার, চাল-গমের এমএসপি থেকে লাভবান হন প্রধানত পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের চাষিরা। কারণ, তাদের ফসলের অধিকাংশই কিনে নেয় খাদ্য নিগম। অধিকাংশ রাজ্যে চাষিদের উৎপাদনের সামান্যই কেনে সরকার, তাই এমএসপির সুবিধা তারা পান যৎসামান্য। অতএব, এমএসপি বৃদ্ধি ঘোষণা করে চাষির সহায়তা করছে সরকার, এই রাজনৈতিক দাবি প্রশ্নের মুখে পড়তে বাধ্য।
প্রশ্নের মুখে পড়েছে এমএসপি-র দাবিও।কৃষক আন্দোলন এমএসপি- কে বাধ্যতামূলক করতে আইন চেয়েছে।প্রশ্ন হলো, প্রতি রাজ্যের প্রতিটি চাষির এমএসপি পাওয়ার অধিকার যদি বা আইনসিদ্ধ হয়, তা বাস্তবে কার্যকর হবে কি? এমএসপি-র সমর্থকরা দেখিয়েছেন যে, সব রকম ফসলের সরকারী ক্রয় করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা সরকারের সাধ্যাতীত নয়।এমএসপি-বিরোধীদের আপত্তি কেবল টাকার অঙ্ক নিয়ে নয়, ভারতে কৃষিকে কার্যত একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিণত করার প্রচেষ্টা নিয়ে। এমএসপি-তে ক্রয়, সারে ভর্তুকি, পিএম কিসান, ফসল বিমা, প্রভৃতি নানা সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বছরে অন্তত ছ’ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করে।কৃষি সহায়তার বিভিন্ন প্রকল্পে রাজ্যগুলির খরচ একত্র করলে দাঁড়ায় তার চেয়েও বেশি। বিশেষজ্ঞদের একাংশের হিসাব অনুসারে, ভারতে প্রতি হেক্টর কৃষিজমি-পিছু সরকারী খরচ অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকা। কিন্তু প্রায় কোনও চাষিই এক হেক্টর জমি চাষ করে পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করতে পারেন না। অর্থাৎ, ক্রমাগত কৃষির জন্য সরকারী টাকা জুগিয়েও চাষকে লাভজনক করা যাচ্ছে না।
ভারতে এমএসপি চালু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, যখন ভারত খাদ্যে স্বনির্ভর ছিল না। চাষিরা যাতে উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আধুনিক চাষে উৎসাহিত হন, বাজারে ক্ষতির আশঙ্কায় পিছিয়ে না আসেন, সেই জন্য এমএসপি ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী।আজ ভারত খাদ্যে স্বনির্ভরই শুধু নয়, ধান রপ্তানিতে বিশ্বের শীর্ষে।তবু এমএসপি প্রয়োজন হচ্ছে।এ এক দুষ্টচক্র, যেখানে সরকারী সহায়তা প্রদান চাষিকে স্বনির্ভর করার পরিবর্তে আরও বেশি নির্ভরশীল করছে।সরকারী ভর্তুকি প্রাপ্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ছে। অতএব সহায়তা ঘোষণার রাজনৈতিক কৌশল নয়, সরকার সুসংহত নীতি তৈরির পথে হাঁটলেই আখেরে লাভ হবে কৃষক সমাজের।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.