কেন মাসির বাড়ি যান জগন্নাথ?

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

যে ই গৌর , সেই কৃষ্ণ , সেই জগন্নাথ । ভগবান জগন্নাথদেব হলেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং যিনি জগতের নাথ বা জগদীশ্বর । সংস্কৃত ভাষায় জগৎ অর্থে বিশ্ব এবং নাথ অর্থে ঈশ্বর বোঝায় । সুতরাং জগন্নাথ শব্দের অর্থ হল জগতের ঈশ্বর বা জগদীশ্বর । হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে , আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা পালিত হয় । মোট এগারো দিন ধরে জগন্নাথ – সুভদ্রা বলরামকে উৎসর্গ করে চলে আরাধনা । জগন্নাথদেবের প্রধান অনুষ্ঠানই হল এই রথযাত্রা । এই দিন দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে নিয়ে মাসির বাড়ি যান জগন্নাথ ।

সেখান থেকে আবার সাতদিন পর মন্দিরে ফিরে আসেন জগতের নাথ । কিন্তু মাসির বাড়ি কেন ? সেই মাসির নামই বা কী ? কোথায় তাঁর বাড়ি ? জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে অনেকটা ।
কলিঙ্গের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তিনি ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত । মালবদেশের অবস্তীনগরে ছিল ইন্দ্রদ্যুম্নের রাজত্ব । ভগবান শ্রীবিষ্ণুর দর্শন আকাঙ্ক্ষায় আকুল রাজা যখন অন্ন – জল প্রায় ত্যাগ করে বসেছেন তখনই রাজার কানে এল ভগবান শ্রীনীলমাধবের কথা । এক ভক্ত এসে রাজাকে বললেন — ” ভগবান নীলমাধব এই মর্তধামেই বিরাজ করছেন এবং নিত্য পূজিত হচ্ছেন ।

ইনি বিষ্ণুরই এক রূপ । ” কিন্তু তাঁকে পাওয়া যাবে কোথায় ? জানা নেই কারোর । শ্রীনীলমাধবকে খুঁজতে চারদিকে লোক পাঠালেন রাজা । কিন্তু কেউই পেলেন না ভগবানের সন্ধান । ফিরে এলেন সবাই বিফল মনোরথ হয়ে । ফিরলেন না কেবল একজন । তিনি রাজার পুরোহিত বিদ্যাপতি । জঙ্গলে পথ হারিয়ে ঘুরতে লাগলেন বিদ্যাপতি । এরপরের গল্পে এল প্রেমের ছোঁয়া । হারিয়ে যাওয়া বিদ্যাপতিকে উদ্ধার করলেন শবররাজ বিশ্ববাসুর কন্যা ললিতা । ক্রমে ভাব জমে উঠল ব্রাক্ষ্মণতনয় বিদ্যাপতির সঙ্গে শবরকন্যা ললিতার । শবরকন্যা ললিতাকে বিয়ে করে বিদ্যাপতি রয়ে গেলেন জঙ্গলে । বিয়ের কিছুদিন পর বিদ্যাপতি লক্ষ্য করলেন , রোজ রাতেই তার শ্বশুরমশাই বাইরে চলে যান আবার ফিরে আসেন পরদিন দুপুরে ।

তখন শবরের শরীর নানা সুগন্ধে আমোদিত থাকে । কস্তুরী , অগুরু , চন্দন , কর্পূর ইত্যাদির সৌরভ লেগে থাকে তাঁর শরীরে । বিদ্যাপতি খুবই বিস্মিত হলেন । তিনি স্ত্রী ললিতাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন । ললিতা জানাল গভীর জঙ্গলে নীল পর্বতে আছে নীলমাধবের মূর্তি । বিশ্ববাসু সেখানেই রোজ পুজো দিতে যান । নীলমাধবের সন্ধান পেয়ে তো দারুণ খুশি বিদ্যাপতি । মনে ভাবলেন – ” এতদিনে সার্থক হল আমার হারিয়ে যাওয়া । ” ব্যাকুল হয়ে উঠলেন বিদ্যাপতি নীলমাধবের দর্শন লাভের জন্য । প্রথমে নারাজ হলেও নাছোড়বান্দা জামাইয়ের অনুরোধ মেনে নিলেন বিশ্ববাসু ।

তবে শর্ত একটাই – বিদ্যাপতিকে সেখানে যেতে হবে চোখ বেঁধে । শ্বশুরের প্রস্তাবে রাজি হলেন বিদ্যাপতি । যাওয়ার সময় হাতে নিয়ে নিলেন কিছু সর্ষে । আর সারা রাস্তা ওই সর্ষে ছড়াতে ছড়াতে চললেন । এভাবে অবশেষে বিশ্ববাসুর সঙ্গে ব্রাক্ষ্মণ বিদ্যাপতি উপস্থিত হলেন তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত নীলমাধবের পুজাস্থানে খুলে দেওয়া হল তাঁর চোখের বাঁধন । শ্রীনীলমাধবের অপূর্ব নয়নাভিরাম মূর্তি দেখে আনন্দে আত্মহারা , আপ্লুত বিদ্যাপতি ভক্তি ভরে পুজো দিলেন দেবতার । তখনই হল দৈববাণী । ভগবান নীলমাধব ভক্ত শবরকে বললেন —- এতদিন আমি দীন – দুঃখীর পুজো নিয়েছি । তোমার বনফুল আর বনফল গ্রহণ করেছি , এবার বিদায় দাও ।আমার অভিলাষ ষোড়শোপচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুন্নের রাজসেবা গ্রহণ করি । ”

নীলমাধবের সংবাদ পেয়ে আনন্দে বিহ্বল রাজা লোকলস্কর নিয়ে উপস্থিত হলেন অকুস্থলে । কিন্তু কোথায় নীলমাধবের বিগ্রহ ? রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ভাবলেন , নিশ্চয় শবর বিশ্বাবসু নীলমাধবকে লুকিয়ে ফেলেছেন । ক্রুদ্ধ হয়ে রাজা সৈন্যদের বললেন শবর বিশ্বাবসুকে বন্দি করতে । তখনই শোনা গেল দৈববাণী —- ” মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ! মুক্তি দাও শবরকে । নীলাদ্রি পাহাড়ের ওপর এক মন্দির স্থাপন করো । সেখানে দারুব্রহ্মরূপে তুমি আমার দর্শন পাবে । নীলমাধব মূর্তিতে নয় ” নির্মিত হল মন্দির ।
মাটির নীচে ৬০ হাত আর মাটির উপরে ১২০ হাত উঁচু মন্দিরের শীর্ষে স্থাপন করা হল একটি সোনার কলস আর চক্র । এবার মন্দির প্রতিষ্ঠার পালা । আবার হল দৈববাণী ।

সেই অনুসারে সাগরজলে ভাসমান শঙ্খ – চক্র -গদা- পদ্ম অঙ্কিত দারুব্রহ্মকে শবর বিশ্বাবসু আর ব্রাহ্মণ বিদ্যপতি নিয়ে এলেন মন্দিরে । এদিকে মহারাজ শ্রীদারুব্রক্ষ্মকে

বিগ্রহে রূপদান করার জন্য বহু সুদক্ষ শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানালেন । কিন্তু তাঁরা কেউই দারুব্রহ্মকে স্পর্শও করতে পারলেন না । আবার শোনা গেল দৈববাণী । জানান দিল — ” সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে যে কাঠ সেই কাষ্ঠ খণ্ড থেকেই তৈরি হবে বিগ্রহ । “
যথাসময়ে সমুদ্রে ভেসে এল কাঠ । কিন্তু হাজার লোকলস্কর দিয়েও সেই কাঠ তোলা গেল না সমুদ্র থেকে । শেষে সেই কাঠের একদিকে ধরলেন শবররাজ আর অন্যদিকে ধরলেন বিদ্যাপতি । তারপরই সমুদ্র থেকে উঠে এল সেই কাষ্ঠ খণ্ড । এবার মূর্তি গড়ার পালা । কিন্তু কীভাবে তৈরি হবে মূর্তি ?

কারণ সেই কাঠ এমনই শক্ত যে কারোর পক্ষেই কাঠে ছেনি – হাতুড়ি ফোটানো সম্ভব হল না মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন রাজা । রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের অসহায়তা দেখে শিল্পীর রূপ ধরে , স্বয়ং জগন্নাথ এসে দাঁড়ালেন রাজপ্রাসাদের দরজায় । নাম অনন্ত মহারাণা । তবে তার একটাই শর্ত । একুশ দিনের আগে কেউ তাঁর কাজ দেখতে পারবে না । রাজার আশ্বাস বাক্যে শুরু হল কাজ । এদিকে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রী রানি গুন্ডিচা প্রতিদিন কান পেতে থাকেন রুদ্ধ দুয়ারে । ভেতর থেকে শোনা যায় কাঠ কাটার ঠক ঠক শব্দ । রানি আশ্বস্ত হন — কাজ চলছে ঠিকঠাক ভাবেই । দেখতে দেখতে কেটে গেল চৌদ্দ দিন । চৌদ্দ দিন পর বন্ধ দরজায় কান পেতে রানি গুন্ডিচা ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ শুনতে পেলেন না ।

অস্থির হয়ে ডাকলেন রাজাকে । দু’জনে মিলে বন্ধ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখেন কারিগর উধাও । পড়ে আছে তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি । গোল গোল চোখ , গাত্র বর্ণসহ অসমাপ্ত মূর্তির না আছে হাত , না আছে পা । অনুশোচনায় আর দুঃখে ভেঙে পড়লেন রাজা – রানি । ভাবলেন শর্ত লঙ্ঘন করার ফলেই বুঝি এত বড় শাস্তি পেলেন তারা । কিন্তু ভগবানের লীলা । রাতেই স্বপ্নে দেখা দিলেন জগন্নাথ । বললেন — ” এমনটা ঠিক করা ছিল আগে থেকেই । আমি এই রূপেই পূজিত হতে চাই । ” এরপর থেকে এই রূপেই ভক্তের মনের মণিকোঠায় পূজিত হতে থাকেন জগন্নাথদেব । পরপর তিনটি সুসজ্জিত রথে চেপে দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে নিয়ে মাসির বাড়ি অর্থাৎ ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচার বাড়ি যান প্রভু জগন্নাথ ।

পুরী শহরের উত্তর কোণে অবস্থিত গুন্ডিচা মন্দির । স্থানীয়ভাবে এই মন্দিরকেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি বলে অভিহিত করা হয় । সেখান থেকে আবার সাতদিন পর মন্দিরে ফিরে আসেন জগন্নাথ । এটাকেই বলে মাসির বাড়ি যাওয়া । এই যাওয়াকে সোজা রথ আর ফিরে আসাকে উল্টো রথ বলে । কেন ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচাকে প্রভুর মাসি বলা হয় ? কেনই বা তিনি মাসির বাড়ি যান ? কথায় বলে ” ভক্তের বোঝা ভগবান বয় । ” পরম ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নীকে মায়ের স্থান দিয়েছিলেন স্বয়ং ভগবান । তাই তো বছরে একবার মাসির বাড়ি গিয়ে প্রকৃত ভক্তের সান্নিধ্য লাভ করেন প্রভু জগন্নাথ । আবার শাস্ত্রে আছে — ” রথস্থ বাম নং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে । ” অর্থাৎ রথের ওপর অধিষ্ঠিত বামন জগন্নাথকে দর্শন করলে তাঁর পুনর্জন্ম হয় না ।

তাই রথের দড়ি টানাকেও পুণ্যের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় । প্রভু জগন্নাথ বুঝতে পেরেছিলেন ওনার স্নানযাত্রায় লাখো লাখো ভক্তসমাগম হবে । তাই তো অনন্ত কৃপাময় শ্রী ভগবান তাঁর বড় দাদা বলরাম আর বোন সুভদ্রাকে নিয়ে রথের ওপর থেকে অগণিত ভক্তকুলকে দর্শন দিয়ে ধন্য করেন। জাতি , ধর্ম , বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনও মানুষ রথের রশি ছুঁয়ে ধন্য হয়ে যান । ভক্তবৎসল কৃপাময় ভগবান নিজেই এ দিন প্রমাণ করে দেন যে তিনি সবার মাঝে সবার হয়ে থাকতে চান। বছরের এই দিনে নেমে আসেন তিনি রত্নবেদী থেকে । মাসির বাড়ি যাবার মধ্য দিয়েই দর্শন দেন তাঁর ভক্তদের । এখন প্রশ্ন হল কেন জগন্নাথের সঙ্গে পূজিত হন সুভদ্রা আর বলরাম ? কে এই সুভদ্রা ? বলরামই বা কে ? মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেন সুভদ্রা । তিনি কৃষ্ণের বোন , অর্জুনের স্ত্রী , এবং অভিমন্যুর মা ।

দেবী দুর্গার অবতার তিনি । কৃষ্ণের পিতা বাসুদেবের ঔরসে রোহিণীর গর্ভে তার জন্ম । তাই তিনি হলেন বলরামের সহোদরা আর কৃষ্ণের বেমাত্রেয় বোন । আর বলরাম হলেন কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা । তিনি বলদেব , বলভদ্র , হলায়ুধ নামেও পরিচিত । পুরাণে বর্ণিত আছে , ভাইবোনের ঘনিষ্ঠ এবং স্নেহপরায়ণ সম্পর্ক মর্তবাসীকে অনুধাবন করানোর জন্যই তাঁরা একসঙ্গে পূজিত । বৈদিক শাস্ত্ৰ অনুযায়ী দ্বাপর যুগে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বভুবনে এসেছিলেন । জগন্নাথ প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণের

অবতারেরই একটি বিশেষ রূপ । বৃন্দাবন লীলা সাঙ্গ করে শ্রীকৃষ্ণ এলেন দ্বারকায় । হলেন দ্বারকার রাজা ।

একবার সূর্যগ্রহণের সময় দ্বারকায় বসবাসকারী সকল অধিবাসীদের নিয়ে পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে শ্রীকৃষ্ণ আসেন কুরুক্ষেত্রে । এদিকে সমস্ত বৃন্দাবনবাসীও পুণ্য লাভের আশায় জড়ো হন কুরুক্ষেত্রে । সেখানে বৃন্দাবনের ব্রজবাসীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় স্বয়ং ভগবান জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণের । ব্রজবাসীরা শ্রীকৃষ্ণকে রাজা হিসেবে দেখতে চান না । তারা শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবনে নিয়ে যেতে চান । তখন ব্রজবাসীরা সকলে মিলে প্রার্থনা করা শুরু করলেন —-
” হে প্রভু আমাদের একটি বিষয়ে খুব অভাব রয়েছে , সেটি হল মধুময় বাল্য লীলা । প্রভু চলো আমরা সকলে মধুময় বাল্য লীলা বৃন্দাবনে ফিরে যাই । ” একথা বলেই সকল বৃন্দাবনবাসী শ্রীকৃষ্ণ , বলরাম , আর সুভদ্রাকে নিয়ে রথের ঘোড়া টেনে টেনে বৃন্দাবনে নিয়ে যান ।

সেই দিনকে স্মরণ রেখেই ভক্তরা আপন মনে ও আন্তরিকতার সঙ্গে আয়োজন করে রথযাত্রার । ভারতের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা হল ওড়িশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা । পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল , শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রাও বিশেষ প্রসিদ্ধ । মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা নিয়ে যে কিংবদন্তি আছে তা একটু জেনে নেওয়া যাক

চতুর্দশ শতক । ধ্রুবানন্দ ব্রক্ষ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে যান তীর্থ করতে । তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল যে তিনি জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন । কিন্তু বাধ সাধলেন পুরীর পাণ্ডারা । মনের দুঃখে অনশনে বসলেন ধ্রুবানন্দ । তিনদিন পর স্বপ্নাদেশ পেলেন তিনি—” বঙ্গদেশে ফিরে যাও ধ্রুবানন্দ । সেখানে ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ নামেতে এক ঘাট আছে । আমি সেখানে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম অর্থাৎ নিমগাছের কাণ্ড পাঠিয়ে দেবো । সেই কাঠে বলরাম , সুভদ্রা আর আমার মূর্তি গড়ে পুজো করো । ” তারপর এক বর্ষার দিনে মাহেশ ঘাটে ভেসে এল এক বিশাল নিম কাঠ । জল থেকে তুলে সেই কাঠ দিয়ে তৈরি হল তিন দেবতার মূর্তি ।

তাদের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে ভক্তিভরে পুজো শুরু করলেন ধ্রুবানন্দ । ওড়িশার তীর্থক্ষেত্র পুরীর আরেক নাম নীলাচল । আর শ্রীরামপুরের মাহেশকে নব নীলাচল বলে আখ্যা দিয়েছিলেন মধ্যযুগের বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ চৈতন্যদেব । পুরী যাবার পথে মাহেশ ঘুরে গিয়েছিলেন তিনি । ভারতের প্রাচীনতম রথযাত্রা শুরু হয়েছিল পুরীতে , আর মাহেশ তার পরে । তাই ভক্তদের কাছে পুরীর পরই মাহেশের স্থান । রথযাত্রায় পিছিয়ে নেই আমাদের ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরাও । ত্রিপুরার রাজারা হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । উনিশ শতকের গোড়ার দিকেই ত্রিপুরার রাজর্ষি রাধাকিশোর মাণিক্য বাহাদুর উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদের সংলগ্নে প্রতিষ্ঠা করেন জগন্নাথ দেবের মন্দির ।

ত্রিপুরার স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন এই মন্দিরটি আট কোণা সমন্বিত । প্রত্যেক কোণায় রয়েছে একটি করে স্তম্ভ । মন্দিরের চূড়াটি অলংকৃত করা হয়েছে দেব – দেবী আর লতা – পাতায় । এক সময় মন্দিরটি ভগ্নদশা ও জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে মন্দিরটি শ্রী চৈতন্য গৌড়ীয় মঠের অন্তর্ভুক্ত হয় । তখন থেকেই ভক্তদের সহযোগিতায় এবং গৌড়ীয় মঠের পরিচালনায় মন্দিরটির শ্রীবৃদ্ধি ঘটে — জানালেন প্রধান মঠ রক্ষক ত্রিদন্ডি স্বামী ভক্তিকমল বৈষ্ণব মহারাজ । এই মন্দিরের সঙ্গেই আছে গুন্ডিচা মন্দির । প্রভু জগন্নাথের মাসির বাড়ি ।
রথযাত্রার দিন শহর পরিক্রমা করিয়ে প্রভুকে রাখা হয় গুন্ডিচা মন্দিরে । সাতদিন পর আবার মূল মন্দিরে ফিরে আসেন জগদীশ্বর । ” রথ ” শব্দের আভিধানিক অর্থ অক্ষ , যুদ্ধযান বা কোনওপ্রকার যানবাহন অথবা চাকাযুক্ত ঘোড়ায় টানা হালকা যাত্রীবাহী গাড়ি ।

তবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ” রথ ” শব্দের অর্থ কিন্তু ভিন্ন । গুরুত্ব এবং শ্রদ্ধার দিক থেকেও বেশ ওপরে । তাদের কাছে রথ একটি কাঠের তৈরি যান , যাতে চড়ে স্বয়ং ভগবান এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যান । আর ভগবানের এই যাত্রায় সামিল হয়ে , রথের রশি টেনে পুণ্য অর্জন করি আমরা ভক্তরা । ভগবানের এই রথযাত্রার কল্পকাহিনি , পুরাণের মিশেল , আর সুদীর্ঘ ইতিহাসের কিছুটা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে । ইতিহাস যাই থাকুক ভগবানের রথযাত্রায় সামিল হয়ে আমাদের চৈতন্যজগতে যে বিপর্যয় ঘটেছে তা দূর হবে , সৃষ্টি হবে মানুষে মানুষে প্রেমের বাঁধন , হবে আমাদের বোধোদয় ।

—– সুস্মিতা ধর

Dainik Digital

Recent Posts

নিগো – অন্ধ প্রশাসন!!

নিগো বাণিজ্যের রমরমা চালানোর জন্যই কি ১৮ সালে রাজ্যের মানুষ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো?রাজ্যের আকাশ…

21 hours ago

বিমানযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে পুলিশের তদন্ত শুরু!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-এয়ারইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের কর্মীর চরম গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণে রীতা বণিক (৫৯) বিমান যাত্রীর…

22 hours ago

হরিয়ানাঃ পাল্লা কার পক্ষে?

হরিয়ানা কি বিজেপির হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে?শাসক বিজেপির হাবভাব দেখে তেমনটাই অনুমান করছে রাজনৈতিক মহল।প্রধানমন্ত্রী…

2 days ago

রাজধানীতে চাঁদার জুলুমে অতিষ্ঠ মানুষ!!

অনলাইন প্রতিনিধি:-মুখ্যমন্ত্রীডা. মানিক সাহার নির্বাচনি এলাকার আপনজন ক্লাবের চাঁদার নামে বড় অঙ্কের তোলাবাজির অভিযোগের রেশ…

3 days ago

ইন্ডিয়ান বুকে রাজ্যের মেয়ে ঝুমা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ইচ্ছে ছিলো অনেক আগে থেকেই। অবশেষে নিজের ইচ্ছেকেই বাস্তবে পরিনত করলো ঝুমা দেবনাথ।…

3 days ago

সুশাসনে আইনশৃঙ্খলা!

রাজ্যে কি সত্যিই আইনের শাসন রয়েছে?সাধারণ মানুষ কিন্তু প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।সরকার বলছে রাজ্যে সুশাসন…

3 days ago