কোটার স্থায়ী দাগ!!

 কোটার স্থায়ী দাগ!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন লইয়া নানান রকম কথা শোনা যাইতেছে।যদিও ইন্টারনেট বন্ধ, ওয়েবসাইট অচল, মোবাইল পরিষেবা বন্ধের কারণে আসল কোনও খবরই আসিতেছে না। আত্মীয় বান্ধবদের খোঁজ মিলিতেছে না।ভারত সরকার প্রতিবেশী দেশের এই আন্দোলন হিংসার ঘটনাকে তাহাদিগের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলিয়াছে।অতঃপর কূটনৈতিক কারণে সেই দেশের ঘটনাবলি লইয়া কাহারো অত্যুৎসাহী বক্তব্য থাকিবে না।কিন্তু রাজনৈতিক মানচিত্রের বাহিরেও যেইহেতু সেই দেশের সহিত ভাষা, সংস্কৃতিতে এক গভীর মিল তাই কৌতূহল এবং উদবেগ হইয়া যায় অসীমান্তিক। বিশেষ করিয়া আগরতলা এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মানুষের উদ্বেগ-কৌতূহলের এক ঐতিহাসিক কারণও রহিয়াছে।বাংলাদেশ শব্দটি অন্য অনেক শব্দের চাইতে আমাদের কাছে আপন বলিয়া মনে হয়।
১৯৫১ সালের এক ছাত্র আন্দোলন থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আওয়াজ উঠিয়াছিল, রাষ্ট্রভাষা বাঙ্গলা চাই।এই দাবি মিটাইয়া দেওয়া তদানীন্তন পাক শাসকদের জন্য বিশেষ কোনও কঠিন কিছু ছিল না।কিন্তু শাসক তো শাসকই।সেই ছাত্র মিছিলে গুলী চালানো হইলো।রক্তাক্ত হইলো রাজপথ।ভাষার দাবিতে যেই ছাত্র মিছিল পথে নামিয়াছিল সেই মিছিল ২০ বৎসর পরে বাঙ্গলা ভাষাভিত্তিক এক স্বাধীন দেশ বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভূখণ্ড হইতে মুক্ত করিয়া লইলো।১৯৭১ সালে শত শহিদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্র পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্রে স্থান করিয়া লইলো।মুক্তিযোদ্ধাদের আআত্মবলিদান,তাহাদের পারিবারিক যে বিপর্যয় সেই সব মনে রাখিয়া তাহাদের পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের কর্তব্য হিসাবে সরকারী ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ সংরক্ষণের ঘোষণা দেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, পরবর্তীতে যিনি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সময়ে যে মুক্তিযোদ্ধার ঘরে দুই বৎসরের সন্তান ছিল কিংবা যুদ্ধশেষে যে মুক্তিযোদ্ধার বয়স ছিল ২২ বৎসর তাহাদের বয়স আজকের দিনে যথাক্রমে ৫৭ বৎসর এবং ৭৫ বৎসর হইবে। উহাদের কাহারই আজ আর কোটার প্রয়োজন নাই কারণ তাহাদের কলেজে যাইবার বা নতুন করিয়া সরকারী চাকুরি লইবার বয়স নাই।তাহা হইলে মুক্তিযোদ্ধার কোটা আজ কাহারা লইতেছেন। নিঃসন্দেহে তাহারা মুক্তিযোদ্ধার তৃতীয় প্রজন্ম। ইহাদের দেশ স্বাধীন করিবার ক্ষেত্রে আলাদা কোনও ভূমিকাও নাই। আন্দোলনকারীরা এই যুক্তি তুলিয়া আন্দোলন শুরু করিয়াছিল ২০১৮ সালে।সরকার পক্ষ তাহাদের প্রতিনিধিদের ডাকাইয়া লইয়া তাহাদের সকল কথা শুনিয়াছিল।কিন্তু সিদ্ধান্ত লইয়াছিল হটকারী।ফলে ২০২৪ সালে আরও মারাত্মক, তীব্র ও বীভৎস চেহারা লইয়া ফিরিয়া আসিল কোটা সংস্কার আন্দোলন।২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার সকল রকম কোটা বন্ধের সিদ্ধান্ত জানাইলো।যদিও আন্দোলনকারীরা কখনোই মহিলা কোটা,পশ্চাৎপদ জেলার কোটা, নৃ জনগোষ্ঠীর কোটা বা বিকলাঙ্গের কোটা লইয়া কথাই বলে নাই। তাহারা কেবল মুক্তিযোদ্ধার কোটা সংস্কারের কথাই বলিয়াছিল।অগত্যা ফল যাহা হইবার তাহাই হইলো। মহিলা কোটার দাবিতে হাইকোর্টে মামলা হইলো।গত জুন মাসে হাইকোর্ট এই মামলায় জানাইয়া দিল, সরকার ২০১৮ সালে যে পন্থায় কোটা বাতিল করিয়াছে তাহা বেআইনি। কোটা পূর্বের মতনই চালু থাকিবে।
হাইকোর্টের এই রায়ের পর ফের আন্দোলন শুরু করে ছাত্ররা।সপ্তাহ, দশ দিন ধরিয়া বাংলাদেশে এই দফায় ছাত্রদের আন্দোলন চলিতেছে।প্রথম দিকে শান্তিপূর্ণভাবেই চলিতেছিল। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয় মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ প্রবেশের পর।চার ছাত্রের মৃত্যু এবং এর পূর্বে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার একটি বক্তব্য ছাত্র আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দেয়। কথাচ্ছলে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলিয়া বসিয়াছেন। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় সকলের সম অধিকারের কথা বলা আছে। ২৮, ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদেও একই সুরে বলা হয়েছে নাগরিকদের যেন ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা সুযোগ দেওয়া না হয়। মহিলাদের উন্নয়নের কথাও সংবিধানে লিপিবদ্ধ রহিয়াছে।সেই দিক হইতে সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা নাই।
মঙ্গলবার হইতে শনিবার অবধি এই কয়দিনে ছাত্র আন্দোলন ক্রমে বিভীষিকাময় হইয়া উঠিয়াছে।মৃতের সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যাই নাই। সেই সংখ্যা ১৭০/৮০ ছাড়িয়া যাইবে বলিয়া দাবি করা হইতেছে।রবিবার কোটা লইয়া মামলার শুনানি চলিল সুপ্রিম কোর্টে।প্রসঙ্গত জুন মাসে হাইকোর্টের কোটা শীর্ষক রায়ের পুনর্বিবেচনা চাহিয়া সরকার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করিলে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় আগষ্ট অবধি স্থগিতাদেশ জারি করিয়া তাহার ওপর শুনানি গ্রহণে রাজি হয়।আন্দোলন চলাকালে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাইয়া শুনানি আগাইয়া আনিতে তাহার সরকারের ইচ্ছার কথা বলিলেন এবং সেই অনুযায়ী রবিবার শুনানি হইলো।সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়া মুক্তিযোদ্ধার কোটা ত্রিশ হইতে হ্রাস করিয়া পাঁচ শতাংশ করিল।জেলা ও মহিলা কোটা সম্পূর্ণ বাতিল করিয়া দিয়া নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য দুই শতাংশ কোটা বরাদ্দ করিল।বাকি ৯৩ শতাংশই রাখা হইলো মেধাবীদিগের জন্য।
শীর্ষ আদালতের এই রায়কে ছাত্ররা আংশিক সাফল্য বলিয়াছে।কারণ ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘের ভয় এইখানে কাজ করিবে।২০১৮ সালের ঘটনারই যদি ফের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়া যায়? পশ্চাৎপদ জেলা কিংবা নৃগোষ্ঠীর কেহ যদি তাহাদের জন্য চিহ্নিত কোটার মাত্রাকে অপ্রতুল বলিয়া আদালতে দাবি করেন তাহা হইলে সেই দায় কাহার ওপর বর্তাইবে। ছাত্ররা সেই দায় কেন লইবেন?তাহারা তো কেবল মুক্তিযোদ্ধার কোটার সংস্কার চাহিয়াছিলেন, অন্যগুলি নহে।আমরা প্রত্যাশা করিব বাংলাদেশ আগের স্বাভাবিকতায় দ্রুত ফিরিয়া আসুক।ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরিয়া যায়,সরকারী চাকুরিতে তাহাদের সুযোগ তৈরি হোক।আবার এই কথা অনস্বীকার্য যে এই বিষয়টিকে লইয়া যেইভাবে এতোগুলি প্রাণের অপচয় হইলো তাহা মানিয়া লওয়া যায় না।এই ঘটনা শেখ হাসিনার রাজনীতিতে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্থায়ী দাগ রাখিয়া যাইবে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.