কোভিডকালে হারিয়ে যাওয়া মাকে পেলো নন্দু ।।।

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অনলাইন প্রতিনিধি || কোভিড ওয়ানের তীব্র লকডাউনের সময়ে হারিয়ে গিয়েছিল মানসিক ভারসাম্যহীন এক মা। ছেলেও মানসিক ভারসাম্যহীন। সে ঘরেই ছিল। মাকে খোঁজা দরকার, সেই কথা ভাবার ক্ষমতাও তার ছিল না। ঘটনাটি রাজনগর পঞ্চায়েতের প্রকাশ নগর গ্রামে। বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আগেই। ফলে তিন কূলে তাঁদের আর কেউ ছিল না খবর নেওয়ার। ঘরে একা নন্দদুলালকে প্রতিবেশীরা এখনও খাবার এগিয়ে দিত, কখনও চেয়ে খেত। কুকুর শিয়াল আর নন্দর সহাবস্থান ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে গেল মানুষের কাছে। জঙ্গলাকীর্ণ বাড়িতে দিনদুপুরেই মানুষজন ঢোকার সাহস পেতেন না। সেই নন্দদুলাল ফিরে পেলো মাকে, এলাকার হৃদয়বান কিছু মানুষের সহায়তায়। নন্দদুলাল সিংহ। বয়স ৩২ এর আশেপাশে। তিন পুরুষ ধরে এই গ্রামের বাসিন্দা। দাদু নারায়ণ সিং সরকারী চালের গুদামের পাহারাদার ছিলেন ৷ বাবা ছিলেন ওই গুদামেরই শ্রমিক। নন্দু মাধ্যমিক পাসের পর রাজনগর বাজারে স্টেশনারির দোকান খুলে বেশ পরিচিতি পায়। এক সময় একটি ছোট গাড়িও কেনে। নিজে চালাতো, ভাড়া খাটাতো। বাবার জীবদ্দশাতেই বোনের বিয়ে হয়। ২০১৯ এর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে নন্দুর দাদু, বাবা দুজনেই মারা যান। এই মৃত্যুগুলির পর বাজার ও পাড়ার মানুষ জানতে পারেন নন্দুর মাথায় বিশাল ঋণের বোঝা রয়েছে। পাওনাদারদের আনাগোনা বাড়লো। খুব অল্প সময়ের মধ্যে নন্দুর দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। তার গাড়িটি কোথায় গেল তার খবর কেউ জানলো না। কিছুদিনের মধ্যেই নন্দুকে বাজারের লোকজন মোবাইল নন্দু বলে চিনতে শুরু করলো। একেবারে অন্য মানুষ। হাতে মোবাইল না নিয়েও কান আর মুখের মাঝামাঝি হাতটা ধরে বিড়বিড় করে কথা বলে বাজারের এই মাথা ওই মাথা ঘুরে বেড়াতো। একেবারেই অপ্রকৃতিস্থ চেহারা, কথাবার্তা অর্থহীন, চেহারায় বদ্ধ উন্মাদের ছাপ। একই অবস্থা তার মায়েরও। রান্না, খাওয়ার বালাই নেই। পাড়ায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো সারা রাত। মানুষজন দেখলে ক্ষেপে যাওয়া সবগুলি উপসর্গই তাঁকে গ্রাস করেছিল। ২০২০ এর শুরুতে এলো করোনা কাল। লকডাউন আর রোগের আতঙ্কে মানুষ দিশাহারা। মোবাইলে টিভিতে ভেসে আসা খবর আর গুজবে দিন কাটে মহাভয়ে। সেই সময়ে বিলোনীয়া আমজাদনগরের একটি ঘটনা চোখে পড়ে রাজনগরের মানুষজনেরও। এক মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরে মহিলাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে লোকজন। ওই মহিলাটি মোবাইল নন্দুর মাই ছিল। এরপর আর ঘরে ফেরেনি নন্দুর মা। নন্দুও দিনে দিনে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেল। কোভিডের পর কোভিড। পরিবেশ ফিরলেও ফিরলো না নন্দুর মা। নন্দুও তার জঙ্গলাবাড়ির পরিত্যক্ত ঘরেই থাকে। কখনও প্রতিবেশীর দরজায় দাঁড়ায় খাবারের জন্য। তাঁরা
খাবার দিলে, বা না দিলেও ঘরে ফিরে যায়। গত মাস দুয়েক ধরে নন্দু ঘর থেকে বের হচ্ছিল। বাজারে ঘুরছিল ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে। সব এলাকাতেই কিছু কিছু মানুষ থেকে যায় যারা পরোপকাে নিজের খেয়ে বনের মোষ’ তাড়ায়। এরা না থাকলে পৃথিবীটার যে আরও ক্ষতি হয়ে যেত এই কথা কে না জানে। দক্ষিণ রাজনগরের বিনোদ রায় তেমনই একজন। রাজনগরে তার বইয়ের দোকানে এসে নন্দু একদিন বই পড়তে চায় ৷ এরপর বেলায় বেলায় এসে র‍্যাক থেকে বই নামিয়ে পড়ে আবার গুছিয়ে রেখে যায়। নন্দুকে দেখে বাজারের সবারই মায়া পড়ে গেছে তখন। এখন আর আগের মতন রগচটা ভাব নেই, অর্থহীন কথাও আর বলে না। কথা কম বলছে। আবার শ্রান্ত, ক্লান্তও দেখাচ্ছে। বিনোদের সঙ্গী সুজিত সাহা, পরিমল দেবনাথ, নির্মল দাস প্রমুখেরা এগিয়ে এসে নন্দুর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। খাবার দাবার দিয়ে খাতির যত্ন দিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।দেখা গেল নন্দু তাতে সাড়াও দিতে থাকে। বাজারের কোনও ব্যবসায়ী জামা কাপড় কিনে দেয়।কেউ সেলুনে নেয়।কেউ আদর করে ডেকে তার নখ কেটে দিলেন। বিনোদেরা তার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে স্নান করায়। তার খাবার দাবারের জোগাড় করে দেয়।ঘরের ভোল পাল্টে মনুষ্য বাসের উপযোগী করে দেয়। পঞ্চায়েত প্রধান বেবি দাস রেগার শ্রমিক দিয়ে তার বাড়ির ঝাড়জঙ্গল পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করে দেন।সবাই জানত নন্দু সুস্থ হচ্ছে। কিন্তু তার যে চিকিৎসাও দরকার,তাও জানতো সবাই।কিন্তু এই কাজটি কীভাবে সম্ভব,তা কারও মাথাতেই আসছিল না।তবে নন্দুর এই ভাবে সেরে ওঠার ঘটনা, তার মার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা সোস্যাল মিডিয়ায় তাঁরা তুলে ধরেন ক্রমাগতভাবে।একদিন পিআর বাড়ি থানার ওসি খোকন সাহা বিনোদকে ডেকে নিয়ে মোবাইলে একটি ছবি দেখান। সোসাল মিডিয়ায় নন্দুর মার হারিয়ে যাওয়ার খবর জেনে ছৈলেংটা থানার ওসি ছবিটি পিআর বাড়ি থানার ওসির কাছে পাঠায়।ছবিটি ছৈলেংটা বাজারে আস্তানা নেওয়া ভারসাম্যহীন মহিলার।থানা থেকে ওই মহিলাকে আগরতলায় সরকারী মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।মহিলা নাকি প্রায় সুস্থ হয়েছেন,কিন্তু তার ঠিকানা খোঁজ জানে না পুলিশ।বিনোদেরা ছবি মোবাইলে নিয়ে নন্দুর পাড়ায় যায়, নন্দুকেও দেখায়।নন্দু চিনতে পারে তার মাকে।পাড়ার মানুষ জানায়, ইনি অপুরাণী সিংহ, নন্দুর মা। নন্দু মাকে দেখতে চাইল।মাকে আনতে আগরতলায় যেতেও রাজি হল। কিন্তু অপুরাণীকে কিসের ভিত্তিতে বিনোদদের হাতে ছাড়বে হাসপাতাল?শেষ পর্যন্ত নন্দুদের রেশন কার্ড,আধার কার্ড উদ্ধার হল বাজারের নানান দোকানিদের কাছ থেকে।নানান সময়ে নন্দু এইগুলি বাজারের পথে ঘাটে ফেলে এসেছিল। কুড়িয়ে পেয়ে রেখেছিলেন ব্যবসায়ীরা।থানাকে জানিয়ে বিনোদেরা গাড়ি ভাড়া করে আগরতলায় ছুটে যায় মানসিক হাসপাতালে।কিন্তু হাসপাতালের রোগী,সেল এসব ভালো লাগছিল না নন্দুর।এক ফাঁকে সে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে।ধরে এনে বুঝিয়ে সুজিয়ে তার মার কাছে নেওয়া হয় এবার।সরকারী আনুষ্ঠানিকতা শেষ হচ্ছিল না বলে নন্দুর মাকেও বের করা যাচ্ছিল না,যদিও তিনি ছেলে রাজু (ডাকনাম) এসেছে জেনে ছেলেকে দেখার জন্য ছটফট শুরু করেছিলেন। নন্দু শান্ত করার জন্য এবার তাঁকে তার মার কাছে আনা হলে দুইজনেই দুজনকে চিনে ফেলে।জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ছেলেকে চোখের জলে ভিজিয়ে দেয় মা। মার চোখের জল মুছাতে গিয়ে নিজেই কান্নায় ভাসছিল নন্দু। এই দৃশ্যে হাসপাতালের অন্য রোগী চিকিৎসক, নার্স ও চোখের জল আটকাতে পারছিলেন না।
ডাক্তাররা সে দিন নন্দুকেও পরীক্ষা করেন। ইঞ্জেকশন দেওয়া হল। কয়েকদিন হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দেখাতে হবে জানিয়ে গত আট মে মা ছেলেকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেয় হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ।সেই দিন প্রকাশ নগরে নন্দুদের বাড়িতে পরিচিত,অপরিচিত মানুষের ভিড় লেগে যায়। বাজারের এক ব্যবসায়ী মা ছেলের জন্য গৃহস্থালির সব বাসনপত্র কিনে দিয়ে গেলেন। চাল, মশলা, সবজি সবই চলে এল।দিন তিনেক পর বিনোদেরা বুঝলেন, এইগুলি সব নয়।মা ছেলেকে বাঁচাতে গেলে এখন দরকার পরিবারে সর্বক্ষণের জন্য একজনকে রাখা,যার কথা শুনবে এই দুইজন।কারণ তাঁদের ওষুধগুলি সময়মত চলছিল না। এতে নন্দুর মাও খানিক মেজাজি হয়ে পড়ছিলেন।বিলোনীয়া বনকর এলাকায় নন্দুর বোনের বাড়ি।দিনমজুর পরিবারের বউ। ঘর সামাল দিয়ে মাকে খোঁজা, ভাইয়ের খবর নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।সম্ভব ছিল শুধু মানত করা,মোম জ্বালিয়ে দুবেলা প্রার্থনা করা।মা ফিরে এসেছে শুনে সেও বাপের ভিটেতে ছুটে আসে।চোখের জলে ভাসে, দুঃখে আর আনন্দে।মাকে বুকে জড়ায়, জড়িয়ে রাখে। বিনোদেরা তাকেই দায়িত্ব দেয়। —তুমিই সামলাও। পরিবারটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়ের জামাই, শাশুড়ি। আপাতত নন্দু তার মাকে নিয়ে বনকরে বোনের বাড়িতেই আছে।আছে এক মাসের ওষুধ। বিনোদেরা দিন গুণছে,এক মাস পর তাঁদের নিতে হবে আগরতলায় হাসপাতালে ।

Dainik Digital

Recent Posts

এ কে-৪৭ ও প্রচুর কার্তুজ সহ ৬ বৈরী ধৃত মিজোরামে, চাঞ্চল্য!!

অনলাইন প্রতিনিধি:- বাংলাদেশ থেকে কাঞ্চনপুর মহকুমার ভারত- বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে মিজোরামে যাওয়ার পথে মামিত জেলার…

15 hours ago

ফাইফরমাশ খাটছেন টিএসআর জওয়ানরা !!

অনলাইন প্রতিনিধি :- নিরাপত্তার কাজে নয়, টিএসআর জওয়ানদের খাটানো হচ্ছে আর্দালি হিসাবে। পুলিশ আধিকারিকদের ও…

15 hours ago

ইন্ডিগো আরও একটি দিল্লীর বিমান চালু করছে!!

অনলাইন প্রতিনিধি :- ইন্ডিগো আগরতলা- দিল্লী রুটের উভয় দিকে যাতায়াতে আরও একটি বিমান চালু করছে।…

15 hours ago

ইন্দ্রপ্রস্থে ভোট!!

দিল্লীর বিধানসভা ভোট নিয়ে সরগরম দিল্লী। দিল্লীতে এবার এক আঙ্গিকে বিধানসভা ভোট হচ্ছে। গত পরিস্থিতির…

15 hours ago

বহিঃরাজ্যে গেল “ধানি লঙ্কা”ওরফে ধান্না মরিচ!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ত্রিপুরায় উৎপাদিত" অর্গানিক বার্ড আই চিলি " স্হানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ধানি…

2 days ago

কুম্ভ ইকনমি

২২জানুয়ারী,২০২৪।এক বছরের ব্যবুধানে ২০২৫ সালের ১৩ জানুয়ারি।গত বছরের মেগা ইভেন্টের আসর বসেছিল অযোধ্যায়। এবার মেগা…

2 days ago