Categories: দেশ

কোহিনূরের ভারতে ফেরার সম্ভাবনা নেই

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

রানি প্রয়াত হয়েছেন । বাকিংহাম প্রাসাদের সিংহাসনে এখন চার্লস । কিন্তু মহামূল্য কোহিনূরের কী হবে ? এতিদন যে অমূল্য কোহিনূর রানির মুকুটে জ্বলজ্বল করত , সেই মণি চার্লসপত্নী ক্যামিলার মুকুটে ! কোহিনূর কি আর কোনওদিন ভারতে ফিরবে না ? ৯৬ বছর বয়সে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পরেই এই প্রশ্নগুলি নতুন করে সামনে এসেছে । মায়ের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আনুষ্ঠানিক ভাবে চার্লসকে রাজা ঘোষণা করা হয় । এ বছরের শুরুতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ঘোষণা করেছিলেন , তার অবর্তমানে ‘ কুইন কনসর্ট ’ হবেন যুবরাজ চার্লসের স্ত্রী , ডাচেস অব কর্নওয়াল ক্যামিলা । অতএব , রীতি অনুযায়ী , কোহিনূর বসানো মুকুট উঠেছে ক্যামিলার মাথায় । কোহিনূর আদতে ১০৫.৬ ক্যারাটের হারা । তার জন্মস্থান ভারত । চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতেই ওই হীরা পাওয়া যায়।যদিও ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান ও দাবি করে , কোহিনূরের জনক তারা । কোহিনূরের আদি ইতিহাস নিয়ে এখনও তর্ক রয়েছে । অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন , বহু শতাব্দী আগে কৃষ্ণা নদীর তীরে কোল্লুর খনি থেকে কোহিনুর হীরা উঠে এসেছিল । মোগল আমলের আগে কোহিনূর হীরা সম্পর্কে কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই । প্রথম লিখিত রেকর্ডটি ১৭৩৯ সালের , যখন পারস্যের শাসক নাদির শাহ মোগল রাজধানী দিল্লিতে অভিযান চালান । নাদির শাহ সমগ্র দিল্লি লুট করে আফগানিস্তানে নিয়ে যান । মূল্যবান পাথরে খচিত মুকুটগুলির মধ্যে কোহিনূরও ছিল । ডালরিম্পলের মতে , সেই মুকুটের দাম তাজমহলের চেয়ে চার গুণ বেশি ছিল । বহু প্রজন্ম ধরে সেই মুকুটেজমা হীরা মুঘলদের দ্বারা জড়ানো ছিল । ১৭৪৭ সালে নাদির শাহ নিহত হলে কোহিনুর তার নাতির কাছে আসে । তিনি আবার সেটি ১৭৫১ সালে আফগান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শাহ দুরানিকে ভেট দেন । ১৮০৯ সালে দুরানির প্রপৌত্র , তৈমুর শাহ দুরানির পুত্র সুলতান শাহ সুজা তখন আফগানিস্তানের শাসক । আফগানিস্তান ও ভারতে রুশ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শাহ সুজা ও ব্রিটেনের মধ্যে ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে মিত্রতা স্থাপিত হয় । সে বছরই জুন মাসে মাহমুদ শাহ দুরানি শাহ সুজাকে সিংহাসনচ্যুত করলে কোহিনূরের পরবর্তী যাত্রা শুরু । ‘ শের – ই – পাঞ্জাব ‘ মহারাজা রঞ্জিত সিং লাহোরে শাহ সুজার আতিথেয়তার বিনিময়ে কোহিনুর দাবি করেন এবং সুজা তা দিয়ে দেন । মহারাজা রঞ্জিত সিং লাহোরের এক নামী জহুরীকে দিয়ে ওই হীরা পরীক্ষা করান । তারপর থেকে রঞ্জিত সিং তার পাগড়িতে কোহিনূর বসিয়ে পরতে শুরু করেন । ১৮৩৯ সালে রঞ্জিত সিং তার জ্যেষ্ঠ পুত্র খড়ক সিংকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন । সে বছরের ২৬ জুন , রঞ্জিত সিংয়ের মৃত্যুর একদিন আগে , কোহিনূর নিয়ে দরবারীদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । মহারাজা তখন খুব দুর্বল । হয়ে ইশারায় কথা বলছিলেন । শেষ পর্যন্ত খড়ক সিংকে কোহিনূর দেওয়া হবে । মোটকথা , ব্রিটেনে পৌঁছনোর আগে ভারতের অনেক রাজপরিবারের মধ্য দিয়ে গেছে কোহিনূর । মোগল থেকে বৃটিশ পর্যন্ত কোহিনূর যাদের হেফাজতে থেকেছে , তার জীবনে বয়ে এনেছে দুর্ভাগ্য । কোহিনূরের দখল পেতে বহু রক্ত ঝরেছে । ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল এবং সাংবাদিক অনিতা আনন্দের ‘ কোহিনূর : দ্য স্টোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ইনফেমাস ডায়মন্ড ‘ বইটি এই হীরার অন্ধকার দিকে আলোকপাত করেছে । সে বইতে লেখা আছে ,কোহিনুরের জন্য কারও মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে , কারও চোখ গরম সূচ দিয়ে বিদ্ধ করা হয়েছে । একজন পারস্য রাজপুত্রের কাছ থেকে হীরার উজ্জ্বলতার জন্য তার মুকুটে গলিত সীসা ঢেলে দেওয়া হয়েছিল । ইস্ট ইন্ডিয়ার কর্তা লর্ড ডালহৌসির নজর ছিল কোহিনূরের ওপর । শিখ এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পাঞ্জাব অধিকার করে । সেই সূত্রে ১৮৪৯ সালে লাহোর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এই চুক্তির অধীনে মহারাজা দিলীপ সিং রানি ভিক্টোরিয়াকে ‘ উপহার ‘ হিসেবে কোহিনূর হীরা দিয়েছিলেন । ১৮৫০ সালের ফেব্রুয়ারীতে কোহিনূর হীরাটি একটি ভল্টে লক করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয় । ১৮৫০ সালের ৩ জুলাই বাকিংহাম প্রাসাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডেপুটি চেয়ারম্যান আনুষ্ঠানিকভাবে কোহিনূর হীরাটি রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে উপস্থাপন করেন । ১৮৫১ সালে , কোহিনূরটি লন্ডনের হাইড পার্কে জনসাধারণের দেখার জন্য রাখা হয় । রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট কোহিনূরকে আরও পালিশ করার সিদ্ধান্ত নেন । রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর কোহিনূর সপ্তম এডওয়ার্ডের স্ত্রী রানী আলেকজান্দ্রার মুকুটে রাখা হয় । সেই থেকে ব্রিটেনের শাসকদের মাথায় সেটি শোভা পেতে থাকে । এলিজাবেথ মাথায় যে মুকুটটি পরতেন সেটি প্লাটিনামের । ওই মুকুটেই কোহিনূর বসানো হয় । কোহিনূরটি যখন ব্রিটেনে পৌঁছায় , তখন তা দেখতে ডিমের মতো ছিল । ১৯৩৭ সালে দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জের অভিষেকের সময় ওই প্লাটিনামের মুকুটটি তৈরি করা হয়েছিল । প্রথম সেই মুকুট মাথায় উঠেছিল দ্বিতীয় এলিজাবেথের মা প্রথম এলিজাবেথ সেই থেকে টাওয়ার অব লন্ডনে রাখা থাকে ওই মহার্ঘ মুকুট । ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেই ভারত ব্রিটিশদেরকে কোহিনূর ফিরিয়ে দিতে বলেছিল । পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে পাঠানো উচিত বলেও দাবি ছিল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে । কংগ্রেসের যুক্তি ছিল , মহারাজা রঞ্জিত সিংশু মৃত্যুশয্যায় এমনই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন । ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানও কোহিনূর দাবি করে । তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে ১৮৪৯ সালের লাহোর চুক্তির কথা উল্লেখ করে লেখেন , ‘ লাহোরের মহারাজার সঙ্গে ওই শান্তি চুক্তির কোথাও কোহিনূরকে পাকাপাকি ভাবে ব্রিটিশ রাজ পরিবারে রেখে দেওয়ার উল্লেখ ছিল না । অতএব , সেটি তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক । ‘ ২০০০ সালে আফগানিস্তানও ব্রিটেনের কাছে কোহিনূর দাবি করে । তালিবানের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র ফয়েজ আহমেদ ফেইল বলেন , ‘ হীরার ইতিহাস দেখায় যে এটি আমাদের ( আফগানিস্তান ) কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ভারতে এবং তারপর সেখান থেকে ব্রিটেনে দেওয়া হয়েছিল । তাই আমাদের দাবি ভারতীয়দের চেয়ে শক্তিশালী । ‘ ২০১৬ সালে ভারতের একটি এনজিও কোহিনূর ফেরত দেওয়ার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে । তৎকালীন সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমার কেন্দ্রের পক্ষে আদালতে বলেছিলেন , কোহিনূর ‘ রঞ্জিত সিং ব্রিটিশদের শিখ যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য দিয়েছিলেন । কোহিনূর চুরি করা জিনিস নয় । তাই এখন সেটি ভারতে ফিরে আসাই বিধেয় । ‘ সেই সময় তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সভাপতিত্বে তড়িঘড়ি একটি বৈঠক ডাকা হয় । আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ( এএসআই ) দাবি করে বিবৃতি দেয় , যে সরকার কোহিনূর ফিরিয়ে আনার জন্য সব রকমের চেষ্টা করছে । তবে , এএসআই একই সঙ্গে বলেছিল , কোহিনুর ভারতে ফিরিয়ে আনার কোনও আইনি ভিত্তি নেই । এমনকী সুপ্রিম কোর্ট যদি নির্দেশ দেয় বা সরকার নিজেই যদি কূটনৈতিক উপায়ে কোহিনুর ফেরত দেওয়ার দাবি জানায় , তাহলেও ব্রিটেন রাজি হবে না । কারণ গত ১৭০ বছর ধরে কোহিনূর ব্রিটিশদের সঙ্গে আছে । ২০১৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ভারত সফরে এসেছিলেন । কোহিনূর ফেরত দেওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন , ‘ আমরা যদি এই ধরনের দাবি পূরণ করতে শুরু করি , তাহলে পুরো ব্রিটিশ মিউজিয়াম খালি হয়ে যাবে । ‘ অর্থাৎ , কোহিনূর আর কোনও দিন ভারতে ফিরবে না , তেমন সম্ভাবনাও নেই অদূর ভবিষ্যতে ।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

নিগো – অন্ধ প্রশাসন!!

নিগো বাণিজ্যের রমরমা চালানোর জন্যই কি ১৮ সালে রাজ্যের মানুষ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো?রাজ্যের আকাশ…

19 hours ago

বিমানযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে পুলিশের তদন্ত শুরু!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-এয়ারইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের কর্মীর চরম গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণে রীতা বণিক (৫৯) বিমান যাত্রীর…

19 hours ago

হরিয়ানাঃ পাল্লা কার পক্ষে?

হরিয়ানা কি বিজেপির হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে?শাসক বিজেপির হাবভাব দেখে তেমনটাই অনুমান করছে রাজনৈতিক মহল।প্রধানমন্ত্রী…

2 days ago

রাজধানীতে চাঁদার জুলুমে অতিষ্ঠ মানুষ!!

অনলাইন প্রতিনিধি:-মুখ্যমন্ত্রীডা. মানিক সাহার নির্বাচনি এলাকার আপনজন ক্লাবের চাঁদার নামে বড় অঙ্কের তোলাবাজির অভিযোগের রেশ…

3 days ago

ইন্ডিয়ান বুকে রাজ্যের মেয়ে ঝুমা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ইচ্ছে ছিলো অনেক আগে থেকেই। অবশেষে নিজের ইচ্ছেকেই বাস্তবে পরিনত করলো ঝুমা দেবনাথ।…

3 days ago

সুশাসনে আইনশৃঙ্খলা!

রাজ্যে কি সত্যিই আইনের শাসন রয়েছে?সাধারণ মানুষ কিন্তু প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।সরকার বলছে রাজ্যে সুশাসন…

3 days ago