ক্ষণজন্মার প্রতি শ্রদ্ধা!!
ভারতবর্ষের ধর্মগ্রন্থ কী?এক কথায় উত্তর, আমাদের দেশের সংবিধান।সদ্য এ দেশ সেই সংবিধানের ৭৫ বর্ষপূর্তি উদ্যাপন করেছে পুরনো সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হলে।এমন বিরস, স্বাদগন্ধহীন, নিষ্প্রাণ, নির্জীব অনুষ্ঠানটি দেখার পর মনে হয়েছে, এমন অনাড়ম্বর সংবিধান দিবস উদ্যাপনের খুব কি দরকার ছিল?রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতির বক্তৃতা, তাও লিখিত ভাষণ পাঠ।মঞ্চে উপবিষ্ট সরকার এবং বিরোধী পক্ষের কুশীলবদের ব্যাদান মুখে বসে থাকা। এমন দৃশ্যপট আর যাই হোক, কোনও উৎসব উদ্যাপনের হতে পারে না। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা যে স্বপ্ন নিয়ে, যে ভারতের কথা কল্পনা করে এটির রচনা করেছিলেন, আজ তারা জীবিত থাকলে ৭৫ তম বার্ষিকী উদ্যাপনের এমন নিষ্প্রভ প্রকরণ দেখলে গণপরিষদে আম্বেদকরের সর্বশেষ ঐতিহাসিক বক্তৃতার কথাই তাদের মনে পড়তো। সংবিধান সম্পর্কে এমন উদাসীনতার আবহ যে তৈরি হতে পারে, ভাবতে অবাক লাগে, এ রকম একটা পরিস্থিতির নিশ্চিত উদ্ভব- সম্ভাবনার কথা ক্ষণজন্মা ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো আম্বেদকর অনুমান করেছিলেন এবং তা চিহ্নিত করেছিলেন আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে। ভারতীয় সংবিধানের মূল রচয়িতা কে, এই প্রশ্নের উত্তরে স্কুল পড়ুয়ারাও নির্দ্বিধায় হাত তুলে বলবে, ভীমরাও রামজি আম্বেদকর (যদিও তিনি নিজে কখনও এমনটা দাবি করেননি)।তার নাম আমরা স্মরণে রেখেছি, কিন্তু তার উচ্চারিত কথাগুলি গণস্মৃতি থেকে প্রায় মুছে গেছে।আমাদের সংবিধান যেদিন গৃহীত হয়, তার পূর্বাহ্নে ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর ভারতীয় গণপরিষদে তার সর্বশেষ বক্তৃতায় আম্বেদকর ভারতীয় গণতন্ত্রের সামনে সম্ভাব্য বিপদের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারী ভারত স্বাধীন সাবভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে ঠিকই, কিন্তু এ দেশের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ কী? দেশবাসী কি এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে, নাকি আবার তারা স্বাধীনতা হারিয়ে স্বৈরাচারের কবলে পড়বে?
তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন-এমন নয় যে, ভারত আগে কখনও স্বাধীন ছিল না।দেশ স্বাধীন ছিল, কিন্তু দেশ তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারেনি।ভারত তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল পারস্পরিক সন্দেহ আর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। আমাদের কপালে সুদীর্ঘ দাসত্ব জুটেছিল।ইতিহাস কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে? আম্বেদকরের দুশ্চিন্তার কারণ ছিল, কেননা আমাদের পুরনো শত্রু জাত আর বর্ণবিভাজনের সঙ্গে নতুন শত্রু পরস্পর-বিরোধী বহু রাজনৈতিক দল আর তাদের সঙ্কীর্ণ মতাদর্শের আবির্ভাব ঘটেছিল। সেই বক্তৃতায় আম্বেদকর বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলি যদি দেশের কল্যাণের চেয়ে তাদের মতাদর্শকেই প্রাধান্য দেয়, তা হলে স্বাধীনতার বিপদ অবশ্যম্ভাবী। গণতান্ত্রিক সংবিধানের বিপন্নতা অনিবার্য, অপ্রতিরোধ্য।আর যদি দেখা যায় সংবিধানের অপব্যবহার ঘটছে,তাহলে ‘আই উইল বি দ্য ফার্স্ট টু বার্ন ইট।’অপব্যবহার ঘটলে তারই তত্ত্বাবধানে রচিত সংবিধান তিনি জ্বালিয়ে দেবেন, বলেছিলেন আম্বেদকর।
আম্বেদকর স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন,একটা সময় ছিল, যখন ভারত শাসিত হত প্রজাতন্ত্রের দ্বারা।রাজতন্ত্রও ছিল। কিন্তু রাজা হতেন নির্বাচিত রাজা। তার ক্ষমতাও ছিল সীমিত। তারা কেউই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। এ দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের কথাও জানত। আম্বেদকর বৌদ্ধ ভিক্ষু সঙ্ঘের কথা উল্লেখ করে বললেন যে, বৌদ্ধ সঙ্ঘ আসলে এ কালের পার্লামেন্ট। কালক্রমে দেশ এই ব্যক্তিস্বাধীনতা আর তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছিল।দেশ কি আবার তা হারাতে চলেছে?তিনি বলেছিলেন, যেখানে গণতন্ত্রের অনুশীলনে দীর্ঘ দিন ছেদ পড়ে গেছে, সেখানে গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত একনায়কতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে। আকারে প্রকারে গণতন্ত্রের ঠাট বজায় রইল, কিন্তু কাজকর্মে তা নায়কতন্ত্রের শাসনে পর্যবসিত হল।এর থেকে অব্যাহতির উপায় কী? আম্বেদকর জন স্টুয়ার্ট মিল-এর সতর্কবাণী স্মরণ করেছেন-গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে কোনও মহাপুরুষের চরণে স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়া চলবে না, কিংবা তাকে এতটা ক্ষমতা অর্পণ করা যাবে না যাতে তিনি সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলতে পারেন। আম্বেদকর মনে করতেন, ধর্মের ক্ষেত্রে ভক্তি বা ব্যক্তিপুজো আত্মমুক্তির একটা পথ হতে পারে। কিন্তু রাজনীতিতে ব্যক্তিপুজো নিশ্চিত ভাবে স্বৈরতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে। আম্বেদকরের মনে হয়েছিল যে, রাজনৈতিক গণতন্ত্র যথেষ্ট নয়।
রাষ্ট্রের প্রকৃত বিকাশে প্রয়োজন সামাজিক গণতন্ত্র- যা সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতাকে সমাজজীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসাবে স্বীকৃতি দেবে। সাম্য না থাকলে স্বাধীনতা সমষ্টির উপরে মুষ্টিমেয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। সাম্য না থাকলে স্বাধীনতা ব্যক্তি-উদ্যোগ বিনষ্ট করবে। সংবিধানের ৭৫ বর্ষপূর্তিতে ত্রিকালদর্শি, ক্ষণজন্মা সেই মানুষটির প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।