ক্ষতিকারক প্রতিফলন

 ক্ষতিকারক প্রতিফলন
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতা বিভাজন নিয়ে বিতর্ক ও বিরোধ ভারতের রাজনীতিতে নতুন ঘটনা নয়। বরং বিভিন্ন সময়ে এই বিতর্ক ভারতের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য মাত্রা পেয়েছে। শেখ আব্দুল্লা থেকে শুরু করে জ্যোতি বসুর মতো মুখ্যমন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্র – রাজ্য সম্পর্ক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে ইতিপূর্বে সারকারিয়া কমিশনও গঠিত হয়েছে। কিন্তু এই বিরোধের নিরসন হয়নি। সম্প্রতি ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রকৃতি নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ক্ষমতা ও দায়িত্ব ভাগাভাগির বিষয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা ও দায়িত্বের বন্টন নিয়ে বিবাদ সাধারণ ঘটনা। তবে এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব খুব বেশি হলে মারাত্মক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি দিল্লীর নির্বাচিত সরকারের হাত থেকে কিছু কিছু ক্ষমতা অন্যত্র হস্তান্তরের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি অধ্যাদেশ এবং সংসদে সেই বিলটি পাস করিয়ে নেওয়ার ঘটনা নতুন করে রাজনৈতিক মহলে আলোড়নের সৃষ্টি করেছে।কেন্দ্রীয় সরকারের অধ্যাদেশ অনুসারে বলা হয়েছে, দিল্লী প্রশাসনের সরকারী আমলাদের নিযুক্তি ও বদলির ক্ষমতা কেন্দ্র নিজের হাতে রাখবে।দিল্লীর নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা কার হাতে থাকবে এই সংক্রান্ত একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের সর্বসম্মত রায় ছিল, পুলিশ জমি এবং আইনশৃঙ্খলা ছাড়া বাদবাকি প্রশাসনের সমস্ত ক্ষমতা দিল্লীর নির্বাচিত সরকারের হাতে থাকবে। কোনভাবেই তা কেন্দ্রের নিযুক্ত উপরাজ্যপালের হাতে নয়। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অকার্যকর করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লী অর্ডিন্যান্সের পথে পা বাড়ায়। তার আগে অবশ্য কেন্দ্র এই রায় পর্যালোচনার জন্য আর্জি জানিয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে গ্রীষ্মকালীন অবকাশের কারণে কেন্দ্র অধ্যাদেশ জারি করে। অথচ সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে একথাও বলেছিল, সংবিধানের কাঠামো দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথাই বলে এবং এটাই হল গণতন্ত্রের চাহিদা।এই বিতর্কের মধ্যেই সম্প্রতি সংসদের উভয় কক্ষেই পাস হয়ে গেল দিল্লী সার্ভিসেস বিল ২০২৩। কিন্তু এই বিল পাস করাতে নবীন পট্টনায়কের বিজু জনতা দল এবং জগনমোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস যে কায়দায় কেন্দ্রের শাসক সরকারের পাশে দাঁড়াল তা বিরোধী রাজনীতির মেরুকরণকে শুধু আড়াআড়ি ভাবেই দুইটি শিবিরে ভাগ করলো তাই নয়, বরং ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যুক্তরা ভাবেই দুইটি শিবিরে ভাগ করলো তাই নয়, বরং ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর এককেন্দ্রীকতার ঝোঁককে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিল। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর এককেন্দ্রীকতার ঝোঁককে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিল। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মূল শর্তই হচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও বোঝাপড়া। নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যবাদ কখনোই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্থিতিস্থাপকতা দিতে পারে না। হতে পারে জাতীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টির মাধ্যমে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে জাতীয় স্বার্থকেই সবার আগে প্রাধান্য ও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও ক্ষমতার আধিপত্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে প্রাদেশিক ক্ষমতা ও এক্তিয়ারকে যদি প্রায় একচ্ছত্র ভাবে কেন্দ্রের হাতে তুলে নেওয়া হয় তখন সেটা আর যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো থাকে না। বরং তা যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের আড়ালে এককেন্দ্রীক শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠারই নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। দিল্লী সার্ভিসেস বিল ২০২৩ তারই একটা নিদর্শন মাত্র। আমাদের দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার বন্টন নিয়ে বিরোধ কম হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এই নিয়ে রাজ্যগুলির ক্ষোভ বেড়েছে। বর্তমানে নতুন করে এই কেন্দ্রীকরণের ঝোক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য সুখকর বার্তা নয়। দিল্লী সার্ভিসেস বিল ২০২৩, এখন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর গেজেট নোটিফিকেশনের দ্বারা আইনে পরিণত হবে। এর ফলে দিল্লী সরকারে নিযুক্ত আমলা ও কর্মচারীরা। কোন পদে কে কবে নিযুক্ত হবেন, কতদিন তারা ওই পদে থাকবেন সেটা আর দিল্লী সরকারের হাতে রইলো না। পরিবর্তে এই সিদ্ধান্ত থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি প্রাদেশিক সরকার জনগণের জন্য সুশাসন ও সেবা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করা পারবে না, সেটা ঠিক করবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিনিধি উপরাজ্যপাল — এই বিধিব্যবস্থা কোন ভাবেই যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। মনে রাখতে হবে, ইতিহাসে এই ধরনের বহু পরাক্রমশালী শাসকের পদক্ষেপ পরবর্তী সময়ে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হল সোভিয়েত ইউনিয়ন, যখন যোসেফ স্টালিন সর্বময় কর্তৃত্ব দিয়ে সোভিয়েত সাম্রাজ্যকে বাঁধতে যান। তারই পরিণতিতে বিংশ শতাব্দীর আটের দশকে সোভিয়েত সাম্রাজ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অতি কেন্দ্রিকতা অসন্তোষেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রনীতিবিদ হ্যারল্ড লাস্কি মনে করতেন, সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের ধারণা বিপজ্জনক এবং জনগণের মর্যাদা, ক্ষমতার সুসমবন্টন এবং পারস্পরিক নির্ভরতার যে ভিতকে আগলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠে তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এই নিরিখে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা কৌশল ও যুক্তির অবতারণা আসলে রাজনৈতিক ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের চরম পদক্ষেপ। যা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য অশুভ বার্তা বয়ে আনতে পারে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.