গণেশ বন্দনায় ত্রিপুরাবাসী

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

“ প্রতি বৎসরের মতো এবারেও ভাদ্র মাসের ১৪ তাং শুক্লপক্ষের চতুর্থ তিথিতে পালিত হচ্ছে গণেশ পূজা । | মহারাষ্ট্রে গণেশ পূজা হয় দশদিনব্যাপী । ত্রিপুরার ক্ষেত্রে গণেশ চতুর্থী বা গণেশ পূজা মূলত তিনদিন ব্যাপী । চতুর্থ দিবসে গণেশ বিসর্জন হয় । ত্রিপুরার অল্পকিছু স্থানে গণেশ পূজা দশদিন ব্যাপী করা হয় । ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানের মতো ত্রিপুরাতেও ৩১ আগষ্ট বুধবার থেকে শুরু হয়েছে গণেশ পূজা । গণেশ চতুর্থীর অপর নাম সিদ্ধিবিনায়ক ব্রত । গণেশের আবির্ভাবের পৌরাণিক কাহিনি হলো- সত্যযুগে দেবী দুর্গা কৈলাসে তার দুই সখী জয়া ও বিজয়াকে নিয়ে এক গুহায় গল্প করছিলেন , ওই সময়ে তাদের গল্পে যেন কোনও বাধা না আসে সেজন্য দুর্গাদেবী মনে মনে চিন্তা করে এক অপূর্ব সুন্দর বালকের জন্ম দিলেন । দেবী পাবর্তীর মানস পুত্রের নাম রাখা হলো গণেশ । দেবী পুত্র গণেশের হাতে একটি গদা উপহার দিয়ে গুহার মুখ পাহাড়ায় বসতে বললেন যাতে কেউ গুহার ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে । পুত্র গণেশকে নিয়ে গুহার বাইরে এলে পার্বতী শনিকে দেখতে পেলেন । দেখলেন শনি তাদের দেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে । পার্বতী শনিকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে শনি বললেন- আপনার এই বালকের উপর আমার অমঙ্গল দৃষ্টি পড়তে পারে , তাই মুখ ফিরিয়ে রাখলাম । দেবী পার্বতী বললেন তোমার অমঙ্গল দৃষ্টি আমার গণেশের উপর পড়বে না । আমার মানস পুত্র গণেশকে তুমি দর্শন কর । দেবীর কথায় শনি গণেশকে দর্শন করেন এবং চলে গেলেন । দেবী মানস পুত্র গণেশকে বসিয়ে রেখে দুই সখীকে নিয়ে গল্প করতে লাগলেন । একই সময়ে দেবাদিদেব মহাদেব সেখানে আসলেন । তিনি গুহার ভিতর প্রবেশ করতে চাইলেন । গণেশ তাকে বাধা দিলেন । মহাদেব নিজ পরিচয় দিলেও গণেশ তাকে প্রবেশ করতে দিলেন না । প্রকৃতপক্ষে গণেশ বা শিব কেউ জানত না যে তারা পিতা পুত্র এবং ফলে শিব গণেশের যুদ্ধ শুরু হলো । দেবী দুর্গার শক্তিতে গণেশ বলীয়ান ছিল । যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মহাদেব তার অমোঘ ত্রিশূল ধারা গণেশের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন এবং রাগবশত পদাঘাত করে মস্তকটি চূর্ণ করে দিলেন । গণেশ মৃত্যুর সময় মা বলে চিৎকার করেছিল । ছেলের বিপদ হয়েছে বুঝতে পেরে পার্বতী ছুটে এলেন এবং পুত্র গণেশের মৃত্যু দেখে দেবী শিবের উপর অত্যন্ত ক্রুব্ধ হলেন । তিনি ক্রোধে সৃষ্টি ধ্বংস করতে শুরু করলেন । দেবতাসহ ব্রহ্মা – বিষ্ণু এসে উপস্থিত হলেন । শনিও ছুটে এলেন । শনিকে দেখে দেবী দুর্গা অভিশাপ দিলেন তোমার খারাপ দৃষ্টিতে আমার পুত্রের প্রাণ গেল । তোমার একটি পা পঙ্গু হয়ে পড়ুক । শনির ডান পা তখন খোঁড়া হয়ে গেল । খারাপ দৃষ্টিতে আমার পুত্রের প্রাণ গেল । তোমার একটি পা পঙ্গু হয়ে পড়ুক । শনির ডান পা তখন খোঁড়া হয়ে গেল । ভগবান বিষ্ণু তখন মহাদেবকে বলল তুমি তোমার পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দাও । তাহলেই দেবী দুর্গা শান্ত হবেন । শিব তখন জানালেন প্রভু , গণেশের মাথা নষ্ট করে ফেলেছি , তাই অন্য কোনও প্রাণীর মস্তক ছেদন করে এনে শরীরে লাগাতে হবে । ওই সময়ে কৈলাসে ঐরাবত বংশীয় এক হস্তি শাবকের জন্ম হয়েছিল । দেবতারা সেই শাবকের মাথা কেটে নিয়ে এলে মহাদেব সেই মস্তক গণেশের শরীরে যুক্ত করে তাকে প্রাণ দান করলেন , তখন হস্তিযুক্ত মস্তক হওয়ায় গণেশ পূজা কিভাবে হবে সেই বিষয়ে প্রশ্ন উঠল , তখন ক্ষণে মা ডাক শুনে দেবী দুর্গাও শান্ত হয়েছেন । ভগবান বিষ্ণু তখন বললেন- দেবী , আমরা তিন প্রধান দেবতা তাই বালককে আমাদের শক্তি প্রদান করছি । অগ্রে গণেশের পূজা হবে । গণেশ পূজা প্রথম না করে পূজা করলে দেব বা দেবীরা সেই পূজা গ্রহণ করবে না । দেবী দুর্গা প্রসন্ন হলেন । গণেশ বন্দনা সর্বদা করলে শনি তার প্রতি অমঙ্গল দৃষ্টি দিতে পারে না । উপযুক্ত সময় এলে দেবী পার্বতী এবং মহাদেব তাদের দুই পুত্র কার্তিক এবং গণেশের বিবাহের প্রস্তুতি নেন , ছোট হওয়া সত্ত্বেও গণেশ প্রথম বিবাহ করবেন বলে জেদ ধরেন , তখন শিব – পার্বতী একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন । ঠিক হয় যে প্রথম যে পৃথিবী পরিক্রমা করে আসবে সেই প্রথম বিবাহ করবে । পরদিন ভোরে অগ্রজ কার্তিক বাহন ময়ূর নিয়ে পৃথিবী পরিক্রমায় রওনা দিল । গণেশ ধীরে সুস্থে পার্বতী এবং শিবকে পরিক্রমা করে বলল যে – পিতা মাতাকে পরিক্রমা করলেই পৃথিবী ভ্রমণ হয়ে যায় । এইভাবে কার্তিককে হারিয়ে গণেশ রিদ্ধি ও সিদ্ধি নামে দুই কন্যাকে বিবাহ করেন । কার্তিক চিরকুমার থাকেন । পার্বতীর কোলে বিষ্ণুর বরে ও বিষ্ণুর অংশে গণেশের জন্ম হয় । বিষ্ণুর অংশ স্বরূপ বলে গণেশেরও চার হাত এবং শঙ্খ , চক্র , গদা , পদ্মধারী , মা পার্বতী স্বয়ং তপঃশক্তি বলে তার গণেশকে লাভ করেন । কোনও নায়ক বা পতি ছাড়াই গণেশের জন্ম হয়েছে বলে তার নাম ‘ বিনায়ক ’ , আর ত্রিভূবনের সমস্ত দেবতার ঈশ্বর বলে গণেশ এবং সমস্ত জনগণের পতি বলে ‘ গণপতি ’ , তাকে স্মরণ করে কর্মশুরু করলে তিনি কর্মের বিঘ্ননাশ করেন বলে ‘ বিঘ্ননাশক ’ , সর্বকর্মে সত্বর সিদ্ধি প্রদানের জন্য নাম হলো তার ‘ সিদ্ধিদাতা ’ । এছাড়া পুণ্যক ব্রতে নানা রকম খাদ্য দ্রব্য দেওয়া হয় এবং তা ভক্ষণ করলেই ভুঁড়ি প্রসারিত হয় বলে গণেশ হলেন ‘ লম্বোদর ’ শনির অশুভ দৃষ্টিতে গণেশের মাথা খসে পড়েছিল এবং দেবরাজ ইন্দ্রের হাতির মাথাটি , কেটে স্বয়ং বিষ্ণু লাগিয়েছিলেন । এই কারণে তিনি ‘ হস্তিবদন ’ বা ‘ গজানন ‘ , দীনজনের সদা সেবক বলে গণেশের আর এক নাম হলো ‘ হেরম্বদেব ’ । অপরদিকে পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধ করে একটি দাঁতকে ভেঙে তিনি ‘ একদন্ত ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন । এই গণেশের রং রক্তবর্ণা , দেহের গঠন অণুপম সৌন্দর্যে ভরপুর , সমস্ত দেবদেবীর আশীর্বাদে অত্যন্ত মার্জিত , সংস্কৃতিবান এবং জ্ঞানী দেবতা হিসাবে গণেশ ক্রমশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল । গণেশ জীবকে সর্বসিদ্ধি এবং মোক্ষ দান করতে পারেন । গণেশ পূজার সময় সুবর্ণময়ী , রৌপ্যময়ী অথবা মৃন্ময়ী প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে পূজা করা হয় । আসন , অর্ঘ্য , আচমনীয় , পঞ্চামৃত , স্নান , বস্ত্র , যজ্ঞোপবীত , সিঁদুর , আভরণ , গন্ধ , আতপ চাল , পুষণ ইত্যাদি দ্রব্য বিশেষ মন্ত্রে নিবেদন করতে হয় । বিশেষ কয়েকটি পত্র যথা- মালতি , ভৃঙ্গরাজ , বিল্বপত্র , শ্বেতদূর্বা , বদরীপত্র , ধূস্তরপত্র , শ্রমপত্র , অপমার্গপত্র , বৃহতীপত্র , কবরী , অর্ক , অর্জুন , বিষ্ণুক্ষান্তা , দাড়িমীপত্র , দেবদারু , মরুপত্র , অশ্ব , জাতি , কেতকী , অগস্তিপত্র ব্যবহৃত হয় গণেশ পূজায় । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির গণেশ পূজা করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে এবং তিনি বিজয় লাভ করেন । বিদ্যার্থীরা গণেশ পূজা করলে বিদ্যালাভ করেন । ধনের কামনায় পূজা করলে ধন লাভ হয় । বিধবারা গণেশ পূজা করলে পরজন্মে বৈধব্য থেকে মুক্তি পান । জয়লাভে বা পুত্রলাভে গণেশ পূজা আবশ্যক । পূজা শেষে ব্রাহ্মণ ভোজন আবশ্যক । গণেশ পূজায় কর্মের বিঘ্ননাশ হয় । পূজার ফলে গ্রহ পীড়ার মধ্যে পড়তে হয় না । এই কারণে ব্যবসায় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে , ব্যবসায় সমৃদ্ধি কামনায় চিরকাল গণেশ পূজার প্রচলন চলে আসছে ।

—–মলয় চক্রবর্তী

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

নিগো – অন্ধ প্রশাসন!!

নিগো বাণিজ্যের রমরমা চালানোর জন্যই কি ১৮ সালে রাজ্যের মানুষ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো?রাজ্যের আকাশ…

15 hours ago

বিমানযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে পুলিশের তদন্ত শুরু!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-এয়ারইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের কর্মীর চরম গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণে রীতা বণিক (৫৯) বিমান যাত্রীর…

15 hours ago

হরিয়ানাঃ পাল্লা কার পক্ষে?

হরিয়ানা কি বিজেপির হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে?শাসক বিজেপির হাবভাব দেখে তেমনটাই অনুমান করছে রাজনৈতিক মহল।প্রধানমন্ত্রী…

2 days ago

রাজধানীতে চাঁদার জুলুমে অতিষ্ঠ মানুষ!!

অনলাইন প্রতিনিধি:-মুখ্যমন্ত্রীডা. মানিক সাহার নির্বাচনি এলাকার আপনজন ক্লাবের চাঁদার নামে বড় অঙ্কের তোলাবাজির অভিযোগের রেশ…

3 days ago

ইন্ডিয়ান বুকে রাজ্যের মেয়ে ঝুমা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ইচ্ছে ছিলো অনেক আগে থেকেই। অবশেষে নিজের ইচ্ছেকেই বাস্তবে পরিনত করলো ঝুমা দেবনাথ।…

3 days ago

সুশাসনে আইনশৃঙ্খলা!

রাজ্যে কি সত্যিই আইনের শাসন রয়েছে?সাধারণ মানুষ কিন্তু প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।সরকার বলছে রাজ্যে সুশাসন…

3 days ago