গভীরতর অসুখ

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

বর্তমান সময়ে মানব সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় সঙ্কট কী ? এককথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়তো কঠিন । কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় , প্রতিকূল পরিবেশে বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দাড়িয়ে সমাজে বিপন্ন অসহায় মানুষের জন্য প্রতিবাদে মুখর হওয়া এরকম মানুষগুলোর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে । এটাই বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বড় সঙ্কট। সমাজের অন্যায়,অবিচার, নীতিহীনতার বিরুদ্ধে নির্ভয়ে বুক উঁচিয়ে প্রতিবাদী হওয়ার যে মুখগুলি, তার এখন বড় অভাব । আমরা সাধারণ ভাষায় এই ধরনের মানুষকে বুদ্ধিজীবী বলেই অভিহিত করে থাকি ।

এই বুদ্ধিজীবী কথাটির অনেক রকম অর্থ । বাংলা একাডেমিক ব্যবহারিক অভিধানে বুদ্ধিজীবী মানে হলো যারা বুদ্ধির বলে বা বুদ্ধি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে । কিন্তু এটা একেবারেই সাদামাটা অর্থ হয়ে গেল । কারণ বুদ্ধিজীবী সে অর্থে আমরা ব্যবহার করে থাকি এই সংজ্ঞা দিয়ে সেটা নিরুপণ করা সম্ভব নয় । বুদ্ধি খাটিয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন , একথা বললে মনে এই প্রশ্নও আসবে , যারা বিজ্ঞাপনের সংস্থার কাজ করেন , নানা রকম বুদ্ধিস্বপ্নের ও কৌশল খাটিয়ে প্রচারের বিভিন্ন পন্থা পদ্ধতি বের করেন । তারা কী করে বুদ্ধিজীবী হবেন ? কিংবা যারা বুদ্ধি খটিয়ে অন্যায় পথে জীবিকা অর্জন করেন তারা কীভাবে বুদ্ধিজীবী হবেন ?

আসলে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা বা অর্থ খুঁজতে গেলে জানতে হবে- সেই ব্যক্তিটি কার জন্য বুদ্ধি খরচ করছেন । যদি দেখা যায় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সমাজের বা রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য , মানুষের অগ্রগতির জন্য তার চিন্তা- চেতনা ও মননকে কাজে লাগাচ্ছেন তখন বুঝতে হবে এই ব্যক্তিটি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে তার বুদ্ধিকে কাজে লাগাচ্ছেন । এই বুদ্ধি খরচ আর সব বুদ্ধি খরচের উদ্দেশ্য থেকে আলাদা । এই মৌলিক পার্থক্য টা যখন পরিষ্কার হয়ে যাবে তখনই তিনি সমাজের চোখে বুদ্ধিজীবী । অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি জনগণের প্রতি এবং জনগণের জন্য সোচ্চার

এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীর প্রধান কাজ প্রাসঙ্গিক সব বিষয়কে জনসম্মুখে নিয়ে আসা এবং ক্ষমতার বলে যারা অন্যায় ও অনৈতিক কাজ করছেন সেই শক্তিকে বা ক্ষমতার বলয়কে চ্যালেঞ্জ করা । এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সের বিখ্যাত , দার্শনিক জুলিয়েন বেন্দা বলেছেন প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা কখনই ন্যায়ও সত্যের অনাকাঙ্ক্ষিত নীতির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না । তারা দুর্নীতির নিন্দা জানান , দুর্বলকে রক্ষা করে এবং অন্যায় ও অপশাসনের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন ।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলো , দিন যত যাচ্ছে আমাদের চারপাশে বুদ্ধিজীবী হিসাবে যাদেরকে সমাজে আমরা জানি বা চিনি , এনারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করেন । এরা শাসকের হাতে পুরস্কার নেন । শাসকের দ্বারা মনোননীত কমিটিতে তার সম্মানজনক পদ গ্রহণ করেন । ফলে তাদের দ্বারা ক্ষমতাহীন মানুষের পক্ষ নিয়ে কাজ করা যায় না । কারণ বুদ্ধিজীবীদের কাজ করতে হয় ক্ষমতার বিপক্ষে । কিন্তু ক্ষমতার হাত থেকে পুরস্কার নেওয়া বুদ্ধিজীবীরা কিভাবে অন্যায়ের বিপক্ষে গলা ফাটাবেন ? এটা সম্ভব নয় । তাই এদেশেও এর উল্টোটাই হচ্ছে । শাসকেরাও এই কারণেই বেছে বেছে ধরে এনে বুদ্ধিজীবীকে পুরস্কার দেন ।

তাই থেমে যায় প্রতিবাদ । তাই অনেকেই মনে করেন পুরস্কারটাও একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত । পুরস্কারের পেছনেও থাকে অন্য রাজনীতির হিসেব – নিকেশ । এই পুরস্কার রাজনীতি দেশে দেশে একই রকমের অর্থ বহন করে । নোবেল পুরস্কার জয়ী জাঁ পল সাত্র তাই বলেছিলেন , নোবেল পুরস্কার আমার কাছে এক বস্তা আলুর সমান । আবার শিল্পী নাট্যকার উৎপল দত্ত ভারত সরকারের সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- ‘ পুরস্কার দিতে চেয়ে করেছ যে অপমান , কী জবাব দেব তার , শক্তিমান ‘ । অথচ দুঃখজনক ভাবেই মহাত্মা গান্ধীর নাম যেমন কখনই নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য আসেনিতেমনি জগদীশ চন্দ্র বসু ।

মেঘনাথ সাহার নামও সেখানে কোনও দিন উঠেনি । এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ আমাদের চারপাশে আজকাল এত অনিয়ম , অনৈতিকতা কিন্তু যাদেরকে সমাজ বুদ্ধিজীবী বলে জানে , তাদের বিবেক রাজনীতির রং দেখে নিয়ন্ত্রিত হয় । আজ প্রকৃত অর্থেই বুদ্ধিজীবী খুঁজে পাওয়া দুর্লভ । বিভিন্ন সময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা , গণতন্ত্র যখন প্রশ্নের মুখে , নেতাদের দুর্নীতি , অর্থ লোলুপ মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীনদের দৌরাত্ম্য যখন সমস্ত নৈতিকতাকে ছাপিয়ে যায় , তখনও রাজনীতির কাছে বিবেক বন্ধক রাখা বুদ্ধিজীবীরা সমাজের লাভালাভের চেয়ে নিজের লাভের কথা মাথায় রেখে নীরব থাকেন । এ ধরনের দাম্যবৃত্তি মনোভাব যেভাবে সমাজে বেড়ে চলেছে তা বড় সুখের সময় নয় । এর বিরুদ্ধেই সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে । না হলে এই বিপদ সভ্যতা , গণতন্ত্র ও মানবতা গভীর সঙ্কটে ঠেলে দেবে ।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

অর্থনীতির হাল-হকিকত

২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের প্রথম সাত মাসে প্রত্যক্ষ বিদেশি পুঁজি (ফরেন ডাইরেক্ট ইনথবর্ষের প্রথ বা এফডিআই) যা…

20 hours ago

রোমান লিপিকে স্বীকৃতির দাবিতে টি,এস,এফ এর বিক্ষোভ!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-দীর্ঘদিন ধরে টি,এস,এফ দাবি করে আসছে রোমান লিপি কে স্বীকৃতি দেওয়ার।বর্তমানে যে প্রশ্নপত্র…

20 hours ago

কেন্দ্রীয় রিপোর্টে প্রকাশ্যে এলো ত্রিপুরার শিক্ষার বেআব্রু চেহারা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-কেন্দ্রীয়শিক্ষা মন্ত্রকের সর্বশেষ রিপোর্ট এও ফুটে উঠলো ত্রিপুরার স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার বে-আব্রু চেহারা।…

20 hours ago

ত্রিপুরাকে শ্রেষ্ঠ রাজ্য বানাচ্ছে বিজেপি সরকার: সুশান্ত!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-প্রধানমন্ত্রীনরেন্দ্র মোদি সবকা সাথ সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস, সবকা প্রয়াসের স্লোগান দিয়েছেন। আর…

20 hours ago

নি:শব্দে এগোচ্ছে চিন!!

প্রতিবেশী বাংলাদেশে গত ছয়মাস ধরে চলতে থাকা অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একেবারে নিঃশব্দে এগিয়ে…

2 days ago

নেতা-মন্ত্রীদের বারবার ঘোষণা সত্ত্বেও গ্রুপ ডি নিয়োগ হচ্ছে না!!

অনলাইন প্রতিনিধি:-প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা করছে না সরকার। জেআরবিটির মাধ্যমে গ্রুপ ডি পদে নিয়োগ নিয়ে টালবাহানা…

2 days ago