ঘোষের স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ‘দি স্পাইন’
জীববিজ্ঞানীদের প্রাণী শ্রেণিবিন্যাসের নিয়ম অনুসারে মানুষ কশেরুকা বা ভার্টিব্রার সমন্বয়ে গঠিত মেরুদণ্ডী প্রাণী । বিবর্তনের ধারা অনুসারে মানুষ দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে শিখেছে , মেরুদন্ড সোজা হয়েছে । সোজা মেরুদণ্ড আমাদের বলিষ্ঠ বিবর্তনের প্রতীক । কিন্তু এই সোজা মেরুদণ্ড কালচক্রে কোথায় যেন আবার বাঁকা হতে শুরু হয়েছে । যদিও জীববিজ্ঞানীরা রেট্রেগ্রেসিভ বিবর্তনের কথা বলে । কবি শঙ্খ ঘোষ যেন এই ক্রমলুপ্তপ্রায় মেরুদণ্ডের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলেন বহু আগেই , আর এরই ফসল কবির লেখা কবিতা ‘ হামাগুড়ি ‘ । নবারুণ ঘোষ আজ হতে ৩০ বছর আগে চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন । নানা প্রতিকূলতার মাঝে তাকে রূপ দেওয়া হয়তো হচ্ছিল না পরিচালকের । কিন্তু নবারুণ ঘোষ তার মেরুদণ্ডে ও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ । তাই বহু বছর পরে শঙ্খ ঘোষের কবিতার ওপর নির্ভর ‘ দি স্পাইন ‘ স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র বানাতে পিছিয়ে যাননি । প্রতিটি বানাতে যাননি । প্রতিটি জীব অনুকূল পরিবেশেই জীবনের ধ্বনি ছড়িয়ে দেয় , এই ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ আমাদের শেখা উচিত । চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণরূপে প্রতীকী ও বিমূর্ত । কিন্তু এর মাঝেই যেন আমাদের সামনে আয়না মেলে ধরে । এমন এক আয়না যে আয়নার নবারুণ ঘোষ প্রতিদিন মানুষকে দেখেন ক্ষয়িষ্ণু মেরুদণ্ড নিয়ে অস্তিত্ব বিহীন এক জীব হিসেবে বেঁচে থাকতে । মানুষ অন্য প্রাণীদের হতে উৎকৃষ্ট কারণ মানুষের মান ও হুশ এই বিচার বোধ আছে । নবারুণ ঘোষ মানুষের এই বিচার বোধকেই সরাসরি প্রশ্ন করেছেন । সমাজে যখন অবক্ষয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রশ্নের মুখে তখন ‘ দি স্পাইন ‘ তার গল্পের নির্যাস রসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক । গল্পের মূল চরিত্রে সাত্যকি রায়ের ভূমিকায় শাক্তনু শর্মা । পরিচালক তার চরিত্রে এঁকে দিয়েছেন মানসিক জটিলতা । সাত্যকির মানসিক রোগের পেছনে জড়িয়ে আছে এক অস্থির আর্থ – সামাজিক পরিস্থিতি । শান্তুনু শর্মা চরিত্র রূপায়ণের দিকে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন । একজন মানসিক অবসাদগ্রস্ত লোক সাধারণত নিজের ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে রাখার জন্য কিছুটা হেঁয়ালি , দুর্বোধ্য কথার ব্যবহার করে থাকেন । সেই দিক হতে বিবেচনা করলে নবারুণ ঘোষের সংলাপ কঠিন মনে হতেই পারে অনেক দর্শকের কাছে কিন্তু চরিত্র এমনটাই চাহিদা করে । গল্পের অন্য মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে সাত্যকির স্ত্রী রাগিণী রায় , অভিনয়ে মধুমিতা তালুকদার । সামাজিক লজ্জা ও উদগ্রীবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠায় পরিপূর্ণ স্ত্রী হিসেবে মধুমিতা তালুকদার ভাল কাজ করেছেন । বারবার সাত্যকির কঠিন মানসিক অবস্থা যেন সমাজের পাঁচ কান না হয় সেই চিন্তাই যেন বেশি ছিল মধুমিতা তালুকদারের ।এর মধ্যে দিয়ে নবারুণ ঘোষ বলে দিতে চাইছেন আমাদের স্বভাব , ‘ সত্যকে লুকিয়ে রাখা , প্রশ্ন করতে না দেওয়া ‘ ? গল্পের অন্য কিছু চরিত্রে দেখা যায় শুভঙ্কর চক্রবতী ,আশুতোষ দে.সৌরভ চৌধুরী , অরুণাভ ঘোষ , পাবন দে । এরা প্রত্যেকেই ভাল অভিনয় করার চেষ্টা করেছেন । অচেনা পথচারী হিসেবে শুভঙ্কর ঘোষ সামান্য সময়ের জন্য হলেও ভাল করেছেন । সাত্যকি রায় বহুল পরিচিত , যার মানসিক অবসাদের মুহূর্ত অচেনা পথচারী মোবাইলে রেকর্ডিং সাত্যকির বাড়ি বয়ে এসে স্ত্রীকে দেখিয়ে দিয়ে যায় । নবারুণ ঘোষ কি আবার এক প্রশ্ন ছুড়ে দিল আমাদের দেখব , ছবি তুলব , কিন্তু সাহায্য করব না । ‘ গোবিন্দের ভূমিকায় সৌরভ চৌধুরী , বেশ মানানসই । তবে ডাক্তারের ভূমিকায় আশুতোষ দে’র প্রতি পরিচালক আরেকটু মনযোগী হলে ভাল ছিল । একজন মনোচিকিৎসক প্রথম সেশনেই তার রোগীর প্রতি এত বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ হচ্ছেন , আশ্বাস দিচ্ছেন ভাল হয়ে যাবেন , একটু বেমানান । এই ত্রুটিগুলোর প্রতি নবারুণ ঘোষকে যত্নবান হতে হবে । যে কোনও সিনেমায় বিশাল তাৎপর্যপূর্ণ তার আবহ সঙ্গীত । আবহ সঙ্গীত করেছেন অর্ণব চক্রবর্তী , টাইটান দেববর্মা , হালোগ জমাতিয়া । এককথায় অসাধারণ আবহ নির্মাণ । বলতে দ্বিধা নেই প্রতিটি দৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে নিপুণ আবহ নির্মাণ করেছেন তুর্কী ত্রয়ী । সঙ্কর্ষণ ঘোষ রচিত , সুকান্ত ঘোষের সুরারোপিত , তাপস ধরের যন্ত্রসঙ্গীত ব্যবস্থাপনায় সঙ্কর্ষণ ঘোষের কণ্ঠে গাওয়া ‘ এই শরীর খুলে কখনও দেখছ কি ‘ বহুদিন মনে থাকবে । রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র শিল্প তৈরির ক্ষেত্রে ইতিহাস লেখা হলে নিশ্চিত এই গানটি মর্যাদার সঙ্গে নিজের স্থান করে নিতে পারবে । সিনেমেটোগ্রাফি করেছেন দুর্লভ দাস । এই সময়ে যারা ত্রিপুরার স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রে সিনেমাটোগ্রাফিতে হাত পাকাচ্ছে তাদের মধ্যে দুর্লভ দাস অন্যতম । তার আগের কাজের নিরিখে বিচার করলে এই কাজের মান বিশেষ করে কালার গ্রেডিং বড় বেশি চোখে লাগছিল । গল্প নান্দনিক রস হারিয়ে ফেললে গল্প যতই ভাল হোক না কেন , তার হতে রস নেওয়া বড় বেশি দুরূহ হয়ে পড়ে । দুর্লভ দাস আগেও নিজেকে প্রমাণ করেছে । আশা রাখব , আগামী দিনে আমাদের আবার দারুণ কাজ দেখার সুযোগ দেবে । রূপসজ্জায় ছিলেন রূপা নন্দী ও ইন্দিরা সরকার । রূপা নন্দী বরাবরই ভাল কাজ করেন । পোস্টার বানিয়েছেন নভজ্যোতি ভারতী । মেরুদণ্ডবিহীন সরীসৃপ ও মানুষের মিশেলে সাত্যকি রায়ের ছবি দিয়ে পোস্টার ভাল তবে নভজ্যোতি ভারতীর সৃজনশীল দক্ষতা আমরা সবাই দেখেছি । তাই এই ক্ষেত্রে কিছুটা নিরাশ । নান্দনিক রস একটু কম মনে হল । নান্দনিকতা , ঔৎকর্ষ , সৃজনশীলতা— এই তিনের মিলনই যে কোনও শিল্পের মূল উদ্দেশ্য ।চলচ্চিত্রের সাহায্যে এই শিল্পের প্রসার যেমন সম্ভব তেমন সমাজ শিক্ষাও সম্ভব । ‘ দি স্পাইন ‘ আমাদের ‘ অনেককে নিজের বিবেকের সামনে দাঁড় করাবে , সমাজে আমাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাবে , কিন্তু এর সমাধান ? সমাজে কী হচ্ছে এই নিয়ে বিশ্লেষণ লেগেই থাকবে , কিন্তু সমাজ কী হতে পারে .এর উপায় কে বাতলাবে । সিনেমার ভূমিকা অপরিসীম , সমাজের গতি ও ধারাপ্রবাহ ঠিক করে দেবার কাজে । সেই দিক হতে বিচার করলে নবারুণ ঘোষ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন কিন্তু উত্তর দিলেন না । চলচ্চিত্রে কোনও প্রশ্ন উঠে আসলে এর উত্তর কী হবে তা বলে দেবার জন্য পরিচালক কিন্তু দর্শকের কাছে ততটাই দায়বদ্ধ । আশা রাখব , এই দিকটা পরিচালক মনে রাখবেন । অনেক সুবিধা নেই , কিন্তু এই অসুবিধাগুলোকে অগ্রাহ্য করে কেউ কেউ কাজ করে চলেছেন , যারাই কাজ করেছেন , মনের তাগিদে করছেন । ভুল হাজারটা ধরা যেতে পারা যায় । কোনও দর্শক ভুল করবেন যদি কলকাতার মানদণ্ডে এই রাজ্যে বর্তমানে নির্মায়মান চলচ্চিত্রের প্রচেষ্টাকে বিচার করেন কারণ ,
প্রথমত , আমাদের কাছে যে সীমিত সুযোগ – সুবিধা আছে এতেই উৎসাহী , উদ্যমী নবারুণ ঘোষের মতো পরিচালকরা কাজ করছেন , দ্বিতীয়ত , আমাদের রাজ্যে দশমীর পরের শ্রুতিককর্শ গানের জলসার জন্য নিবেদক পাওয়া যায় কিন্তু চলচ্চিত্র বানাবার জন্য নয় । আর এর পরেও যদি সত্যি ভুল ধরতে হয় , আশা করি দর্শকবন্ধুরা সুস্থ আলোচনার পরিবেশ তৈরি করবেন , যেখানে আপনি যেমন ঋদ্ধ হবেন , পরিচালকরাও আরও বেশি পরিপক্ক হবে , তৈরি হবে চলচ্চিত্র নির্মাণের এক উর্বর জমি । তাই দর্শকবন্ধুরা যারা তুলনা করছেন তাদের বলব , একবার তুলনা ছেড়ে দিয়ে চেষ্টাকে সমাদর করুন , ভুল ত্রুটি কী আছে সমালোচনা করুন । দেখবেন এই রাজ্যে একাধিক নবারুণ আপনাদের নিরাশ করবে না ।