চটকলের আখ্যান!!

 চটকলের আখ্যান!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

সর্বস্বান্ত গফুর, গ্রাম ছেড়ে মেয়ে আমিনার হাত ধরে ফুলবেড়ের সর্বমা চটকলের দিকে পা বাড়িয়েছিল বাঁচার জন্য। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পে গ্রামীণ ভারতের ভূমিহীন মানুষের এই দুঃসহ চেহারা নাড়া দিয়েছিল প্রতিটি পাঠকের মনে।কারণ সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় কৃষকরা ছিল ভূমিহীন খেতমজুর।সাথে ছিল জমিদারদের অত্যাচার।ফলে এই আধপেটা ভুখা মানুষগুলোর একমাত্র আশ্রয় ছিল চটকল।ভারতের সব রাজ্যেই এরকমভাবেই কর্মহীন মানুষগুলো চটকলে ছুটে আসত।কিন্তু এতে করে তাদের জীবনের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।তাদের ভাগ্যের চাকা অনিবার্যভাবেই থমকে যায় কিছুদিন বাদেই।তাই এদের না ছিল বর্তমান,না ছিল ভবিষ্যৎ।ত্রিপুরাও সেই অর্থে এর খুব একটা ব্যতিক্রম হয়নি। হয়তো পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল।কিন্তু দেশের আর পাঁচটা চটকলের মতোই ত্রিপুরার একমাত্র মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানটিও যৌবনের আগেই বুড়িয়ে গেল। এখন তো বলা যায়, ভগ্ন স্মৃতি চিহ্ন হয়ে অতীতের অভিশাপ আর বর্তমানের প্রতিশ্রুতির খেলাপের জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত হয়ে হাঁপানিয়ায় ত্রিপুরার একমাত্র চটকলটি আশু কেবলই ভূতুড়ে বাড়ি।
পাটশিল্পের বিপন্নতা এবং অসময়েই চটক গুলোর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার দায় যারই হোক না কেন, এর থেকে উত্তোরণের পথ খোঁজা শুধুই শ্রমিক কৃষকের দায়িত্ব নয়।এক একটি চটকলের সঙ্গে অনেক পরিমাণ শ্রমিক যুক্ত।এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কর্মসংস্থান।প্রতিটি চটকলে উৎপাদন ও কাজের সঙ্গে শুধু শ্রমিক-কর্মচারীই যুক্ত নন, আছেন ম্যানেজার, সুপার ভাইজার, কেরানি সহ অন্তত আড়াই-তিন শতাধিক কর্মচারী। পাটশিল্পের বিপন্নতা ভারত সহ উপমহাদেশের অনেক অঞ্চলেই বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে এলেও এখনও। বিপন্ন শ্রমিকদের রক্ষা করে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা যে হচ্ছে না, তেমন নয়। বিশ্ব এ কথা স্বীকৃত যে, চট এবং ফাইবার হচ্ছে বায়ো ডিগ্রেডেবল এবং পরিবেশ বান্ধব। যেহেতু এটি কৃষি ভিত্তিক ও শ্রমনিবিড় শিল্প, তাই এটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ও কম খরচে সহজলভ্য পণ্যের উৎপাদনজনিত কারণে চটের ব্যবহার ক্রমেই নিম্নমুখী হওয়ায় অন্য সব রাজ্যের মতোই আমাদের রাজ্যের একমাত্র চটকলটি মৃত হয়ে গেছে।কিন্তু নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মতো করে চটকলের সুরক্ষা ও পুনরুজ্জীবনের জন্য ভোটার ভোলানো বহু প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসে বেমালুম স সব কথা ভুলে যায়।একই ঘটনা ঘটেছে আমাদের এই রাজ্যের ক্ষেত্রেও। দুই দফায় সরকারে ক্ষমতায় এসেও চটকলের পুনরুজ্জীবনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি ‘জাফরান দল। একটা কথা বলে রাখা ভালো, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিজেকে যত আধুনিকতা ও প্রকৌশল প্রযুক্তির ছোঁয়ায় উন্নত করার চেষ্টা করছে, বিপর্যয় ততই তাদের গ্রাস করছে। অথচ ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশগুলো নিজেদের বিলাস বৈভবে শীর্ষ স্থানে তুলে আনলেও পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার ও চাহিদা তাদের দেশে ক্রমেই বাড়ছে। পরিবেশ সচেতনতার কারণে প্লাস্টিকের পরিবর্তে পাটজাত পণ্য ব্যবহারের ঝোঁক তাদের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণভাবেই বেশি। অথচ আমাদের মতো রাজ্যে উল্টো পথে হাঁটছে- সরকার থেকে রাজনৈতিক দল সবাই। চটের ব্যবহার এখন সেকেলে, তাই চটকল শিল্প অচল। জুটমিল নিয়ে এভাবেই লোকসানের গল্প ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে কার্যত পরিবেশ সুরক্ষার কাজটাও এরা করতে নারাজ। অথচ ঘটা করে প্রতিবছর এই শহরে শিল্প মেলা হয়। শিল্প নিয়ে মেলায় ভারী ভারী কথা হয়। কিন্তু পাট এবং চটকল নিয়ে সরকার, পরিবেশবিদ, এনজিও, নেতা, মন্ত্রী, আমলা সবাই মুখবন্ধ করে বসে থাকে। ১ টি পাটগাছ বায়ু থেকে যে পরিমাণ শোষণ কার্বন, করে সেই হিসাব তাদের কাছে নেই। ১ টন প্লাস্টিক পোড়ালে যে পরিমাণ কার্বন বায়ুতে ছড়ায়, তার ২০ ভাগের ১ ভাগ কার্বন নির্গত হয় ১ টন চটের সামগ্রী পোড়ানো
হলে।আসলে কর্পোরেটের দাসত্বের সামনে সত্য অসত্যের গালভরা প্রতিশ্রুতি, আর পরিবেশকে নষ্ট করে কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব বাড়িয়ে রাজনীতির কুশীলবেরা যে কায়দায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে চলেছেন তার পরিণাম যে কতটা বীভৎস হতে চলেছে প্রকৃতির রোষানলই এর সবচেয়ে বড় নজির।তারপরেও এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে চাই আওয়াজ, প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের ঢেউ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.