চড়কের সিঁড়ি

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ত্রিপুরার গ্রাম এই সময়ে চড়ক আর গাজনে মজিয়াছে। বৎসরের শেষ দিনগুলিতে এবং নতুন বৎসরের সূচনায় চলিবে চড়কের মেলা। পূর্ববঙ্গীয় রীতিতে ত্রিপুরার গ্রামগঞ্জে লোকাচারের এই পরম্পরা নিজ রঙ্গ আর মহিমায় চলিয়া আসিতেছে। এই গাজন আর চড়ক গ্রামের মানুষের জীবনে এক অন্যতম অধ্যায় হইয়া আছে আজও। অনেক নাগরিক মানুষের মনও এই সময়টিতে গাজন আর চড়কের মাদকতায় আচ্ছন্ন হইয়া থাকে। বস্তুত শুরু হইতেই এই লোকাচারের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আসিয়া গড়াগড়ি দিতেছে। বলা হইয়া থাকে আদি অস্ট্রীক সভ্যতার সহিত নব আর্যদের মিলন কিংবা আদি বাংলার জল-জঙ্গলের যে স্বাভাবিক আচার সংস্কৃতি উহার সহিত বৌদ্ধ মহাযান মতের তন্ত্র সাধনা আসিয়া যুক্ত হইয়াছে।আপাত সরলীকরণে কোনও কোনও পণ্ডিত গাজনকে শিব গৌরীর বিবাহ বলিলেও শেষ পর্যন্ত উহা একটি বিচ্ছিন্ন মত’ হিসাবেই প্রতিপন্ন হয়। গাজনের আচার আচরণে পূর্ববঙ্গীয় ধারা, যাহা এই অঞ্চলে প্রচলিত রহিয়াছে তাহাতে তন্ত্র চর্চা অধিক গুরুত্ব পায়। আবার পশ্চিম বাংলার রাঢ় অঞ্চলে শরীরে বড়শি গাঁথিয়া চড়কের গাছে ঘুরিবার প্রথা কম থাকে। বলা হইয়া থাকে যে সকল অঞ্চলে বৌদ্ধ মহাযান তন্ত্রের প্রভাব বেশি ছিল সেই সকল এলাকায় তন্ত্রসাধনা অধিক দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত গাজন শব্দটির উৎপত্তি হইয়াছে গর্জন হইতে। কিংবা এই গর্জন হইতে। কিংবা এই গর্জন এই সময়ের কালবৈশাখী হইতেও আসিয়া থাকিতে পারে।অন্য অর্থে বলা হইতেছে শিব বা মহাদেবকে লইয়া সন্ন্যাসীদের উচ্চস্বরে যে ধ্বনি তাহার গর্জন হইতেই গাজন। আবার গাঁ কিংবা গঞ্জ মর্থের সহিত জন বা জনগণকেও বুঝানো হইতেছে। গ্রামের সর্ববৃহত এই উৎসবে আজ মানুষ যথাসাধ্য নিজেদের যুক্ত করিয়াছে। সদ্যসমাপ্ত
নির্বাচনের পর নির্বাচনোত্তর সন্ত্রাসে চাঁদাবাজি এখনো নীরবে চলিতেছে। আরও কতদিন চলিবে তাহার ইয়ত্তা নাই। প্রশাসন, মুখ্যমন্ত্রীর কড়া বার্তার পরেও নীরবে চলিয়া থাকে এই ঘটনা। ফলত সাধারণ মানুষ সকলেই যে উৎসবে গা ভাসাইতে পারিতেছেন, এই কথা বলা যাইবে না । সকল সময়েই কিছু মানুষ উৎসবে ব্রাত্য থাকিয়া যায়। কিন্তু তাহাদের সংখ্যা যত কম হয় উৎসব তত জনমুখরতা পায়।তথাপিও বলা যায় গ্রামগঞ্জে মাসব্যাপী গাজনের শেষ পর্বে চড়কের যে উৎসব তাহা নাগরিক জীবনের নববর্ষ বরণের চাইতে অধিক উৎসাহ আর উদ্দীপনার। কোথাও কোথাও এই চড়কের মেলা তিন চার পাঁচ দিন ধরিয়াও চলিয়া থাকে। তবে ভোটের পর প্রশাসনিকভাবে রেগা ইত্যাদি কাজকর্মের অভাব ইত্যাদি ঘটনায় গ্রামের উৎসব আয়োজনে সাধ আর সাধ্যের টানাটানি চলিবে ইহা বুঝিতে কাহারও সমস্যা হইবার ‘কথা নহে। মূলত চড়কের আয়োজকেরা পরম্পরাগতভাবে সমাজের নিম্নবর্ণের লোক। তাহাদের কথায় যে কেউ চড়কের পূজা করিতে পারিবেন না। এই পূজার জন্য সিঁড়ি থাকিতে হয়। অর্থাৎ পারিবারিকভাবে পূর্ব পুরুষ কেহ আদিষ্ট হইয়া চড়কের পূজা করিয়াছিলেন, এই ঘটনা থাকিতে হইবে। একইভাবে সেই পূজায় যাহারা ঢাক বাজাইবেন তাহারাও পূর্বপুরুষের কোনও সিঁড়ি পাইয় তবেই বাজাইবেন। এমনকি এই সময়ে শিবের নিত্যপূজা দান কিংব সন্ধ্যার প্রদীপ, সলতে ইত্যাদি যাহারা দিবেন তাহাদের পরিচয়ও একই রকম।প্রতাপগড় ঋষিপাড়ার হেমন্ত ঋষিদাসই হোন কিংবা পশ্চিম বাংলা পূর্ব বর্ধমান জেলার কুটিগ্রামের খেলারাম দাস, সাতকড়ি দাস সকলে সিঁড়িবাহক ৷ তাহারা টানা একমাস ধরিয়া নানান উপবাস, ব্রত, সিদ্ধভাত কিংবা ফলাহার দিয়া সন্ন্যাসী সাজিয়া পূজা করিয়া থাকেন। শিবে মন্দিরে দাঁড়াইয়া তাহার অনুমতি লইয়া উপবীত ধারণ করিয়া থাকে। কেহ কেহ আজ্ঞা পাইবার জন্য মস্তক মুণ্ডন করিয়াও থাকেন। আবার কোথাও কোথাও গণহারে মস্তক মুণ্ডনও দেখা যায়। এই ঘটনাটি ঘটে চড়ক সংক্রান্তির পাঁচ দিন আগে, অর্থাৎ ২৫ চৈত্রে। এইভাবেই বহিয়া চলিতেছে প্রাচীন বাংলার আদিমতম একটি সংস্কৃতির ধারা বা সিঁড়িভেঙ্গে চলা।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

গয়নার ল্যাবে তৈরি হলো বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম রুবি!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-বাংলায় চুনি, ইংরেজিতে রুবি।চুনির রং কতটা টকটকে লাল, তার উপর এই মানিকের দাম…

12 hours ago

মুখ্যমন্ত্রীর মুখ বাঁচাতে পুলিশ প্রশাসনের নির্লজ্জ দ্বিচারিতা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-চাঁদারজুলুম নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে তথাকথিত সুশাসনের রাজ্যে প্রশাসনের নির্লজ্জ দ্বিচারিতা প্রকাশ্যে এলো।…

12 hours ago

কাজের বাজারে মন্দা!!

কেন্দ্রে ১০০ দিন পূর্ণ করল তৃতীয় মোদি সরকার।যদিও বর্তমান ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারকে মোদি সরকার আখ্যা…

13 hours ago

নিগো – অন্ধ প্রশাসন!!

নিগো বাণিজ্যের রমরমা চালানোর জন্যই কি ১৮ সালে রাজ্যের মানুষ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো?রাজ্যের আকাশ…

2 days ago

বিমানযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে পুলিশের তদন্ত শুরু!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-এয়ারইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের কর্মীর চরম গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণে রীতা বণিক (৫৯) বিমান যাত্রীর…

2 days ago

হরিয়ানাঃ পাল্লা কার পক্ষে?

হরিয়ানা কি বিজেপির হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে?শাসক বিজেপির হাবভাব দেখে তেমনটাই অনুমান করছে রাজনৈতিক মহল।প্রধানমন্ত্রী…

3 days ago