চাহিদা আসে কেমনে!”
একদিকে ‘বিকশিত ভারত’-এর আকাশকুসুম স্বপ্ন বুননের প্রয়াস,এ অন্যদিকে বিরোধীদের কুর্সি বাঁচাও বাজেট বলে কটাক্ষ। একদিকে বাজেট বক্তৃতার ঐতিহ্য মেনেই অর্থমন্ত্রীর অস্পষ্ট বাজেট-ভাষণ, অন্যদিকে বিরোধীদের কটাক্ষ সরকার টিকিয়ে রাখতে জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় অর্থমন্ত্রীর মুখে পূর্বোদয় তথা পূর্ব ভারতের উদয়ের উপর জোরের কথা বলে আদতে নীতীশ কুমারের বিহার আর চন্দ্রবাবু নাইডুর অন্ধ্রপ্রদেশের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া।
তবে এ সমস্ত রাজনৈতিক তরজা বাহ্য।বাজেট পেশ হবে, সরকার পক্ষ ঢাক বাজাবে, বিরোধীরা তাকে বলবেন গরিব-বিরোধী।এ সবই ভারতীয় রাজনীতির চেনা চিত্রনাট্য।জরুরি প্রশ্নটি হলো, এই বাজেট থেকে দেশবাসী কী পেলেন?সমধিক জরুরি প্রশ্ন, বাজেটে সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিল, সেগুলি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতখানি?মঙ্গলবার সংসদে পেশ করা তৃতীয় মোদি সরকারের প্রথম বাজেটের অন্যতম ‘প্রাপ্তি’ হলো, বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থান যে কেন্দ্রের সামনে চ্যালেঞ্জ, বাজেটের মোড়কে সরকার সেটি মেনে নিয়েছে।অর্থমন্ত্রী তাই গোড়াতেই জানিয়ে দেন যে, এবারের বাজেটের কেন্দ্রই (থিম) হলো কর্মসংস্থান, চাকরির প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধি, ছোট- মাঝারি শিল্প এবং মধ্যবিত্ত। প্রায় দেড় ঘন্টার বাজেট-বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী অন্তত পঁচিশবার কর্মসংস্থান কথাটি উচ্চারণ করেছেন।
অতি উত্তম, সন্দেহ নেই। আশু প্রশ্ন হলো, এত কর্মসংস্থান যে তৈরি করা হবে, তার উপযোগী বাজারে চাহিদা আছে কি নেই।বাজেট করে যে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়,এমন অবাস্তব চিন্তা কেউই করেন না।কিন্তু বেকারত্ব নিয়ে সরকার ভাবিত নয়, সেই অভিযোগ থেকে মুক্তিপ্রাপ্তির একটি মঞ্চ অবশ্যই বাজেট।বেকারত্ব আর কৃষকদের দুর্দশা, মূলত এই দুই ছিল এবার বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের নির্বাচনি প্রচারের অঙ্গ।একপক্ষকাল আগে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্টের সূত্রে দেশবাসী জানতে পারে, গত দশ বছরে আঠারো কোটি মানুষ কাজ পেয়েছেন, বেকারত্বের হার নিম্নগামী। যদিও পরে বোঝা যায়, সাধারণ ধারণায় ‘চাকরি’ বলতে যা বোঝায়, এটি তেমন নয়,এই কর্মসংস্থান স্বনিযুক্তি।আর বাজেটে যুবা- বয়সিদের মধ্যে কর্মনিযুক্তির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে অর্থমন্ত্রী যে একগুচ্ছ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন,যা পাঁচ বছর ধরে চলবে, সেটি কতদূর বাস্তব পরিস্থিতিতে সঙ্গত? কর্মসংস্থানের ঘোষণা অর্থনীতির ভাষায় জোগান- সাপেক্ষ নীতি।কিন্তু শুধু দক্ষ ও অদক্ষ কর্মীর জোগান থাকলেই উৎপাদনে বৃদ্ধি হয় না, উৎপাদন তখনই বাড়ে যখন উৎপাদিত পণ্যের জন্য যথেষ্ট চাহিদা থাকে।যে চাহিদা আবার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল।রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট কথিত গত দশ বছরে যে কয়েক কোটি কর্মনিযুক্তি হয়েছে, তা থেকে ওইসব মানুষের যে পরিমাণ আয় হয়েছে তা দিয়ে কি যদৃচ্ছ পণ্য ক্রয় করা যায়? শুধু এবার বলে নয়, নির্মলা সীতারামনের পূর্ববর্তী ছয়টি পূর্ণাঙ্গ বাজেটের নির্যাস তুলে আনা হলে দেখা যাবে, চাহিদার অভাবজনিত সমস্যা সরকারের কাছে বিচার্যই নয়। এমনিতে কর্মসংস্থান ও জিডিপির বৃদ্ধির হারের দিকে তাকালেই চাহিদার স্বরূপটি ধরা পড়ার কথা। কিন্তু সখেদে বলার, এ দেশের সরকারী পরিসংখ্যান ব্যবস্থা এখনও ততখানি স্বচ্ছ নয়। অতএব ভোগব্যয়, বিনিয়োগ এবং রপ্তানির মতো সামগ্রিক চাহিদার খণ্ডচিত্র থেকেই অর্থব্যবস্থার হাল বুঝতে হয় আমাদের। ভোগব্যয় বৃদ্ধির শ্লথতা নিয়ে আগে অনেক অর্থশাস্ত্রীই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। বাস্তবেও দেখা গেলো, গত বাজেটে সরকারের মোট খরচ যা ধরা হয়েছিল, এবার তার থেকে বেড়েছে মাত্র সাত শতাংশ। আর্থিক মূল্য বেশি মনে হলেও মূলবৃদ্ধির হারকে হিসাবে রাখলে, প্রকৃত মূল্য তথা বৃদ্ধি সামান্যই। আর মোট সরকারী ব্যয়? জাতীয় উৎপাদনের (তথা আয়) চেয়ে ১৫ শতাংশ কম! ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে টাকার অঙ্কে নতুন প্রকল্পের ঘোষিত বিনিয়োগের বৃদ্ধির হারও নিম্নমুখী। ফলে বেসরকারী বিনিয়োগের আশু সম্ভাবনা নাস্তি। আসলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় চাহিদাজনিত সমস্যার কথাটি সরকার স্বীকার না করলে কর্মসংস্থানের এমন ঘোষণা দিনের শেষে বহুারম্ভে লঘু ক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। সার্বিক চাহিদা দ্রুত না বাড়লে জিডিপি বৃদ্ধির চড়া হার বজায় রাখা সব দেশের পক্ষেই কঠিন। আর চাহিদা না বাড়লে, কর্মসংস্থানের বিউগল ফোঁকা যায়, কিন্তু আদপে তা বাস্তবায়িত হয় না। বস্তুত, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার উর্ধ্বে উঠে অর্থনীতির বাস্তব ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে সরকার স্পষ্ট ও সংহত বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করার বার্তা দিলেই অর্থব্যবস্থার চাহিদা ফিরতে পারত।বান ডাকতে পারত কর্মসংস্থানে, নচেৎ নয়।