চিরঘুমের দেশে কালবেলার স্রষ্টা
দৈনিক সংবাদ অনলাইন প্রতিনিধি || ক্লাসিকের সঙ্গে মেইনস্ট্রিমের বিরোধ চিরন্তন। কিন্তু ধ্রুপদী সাহিত্যও যেন আপামর পাঠকবর্গের কাছে সমাদৃত হতে পারে, তার জ্বলন্ত নিদর্শন সমরেশ মজুমদারের কলম। তিনিই ছিলেন বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা ঔপন্যাসিক।তার কালজয়ী ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ একই সঙ্গে ধ্রুপদী এবং সর্বস্তরের পাঠকের কাছে জনপ্রিয় এমন অনুপম যুগলবন্দি বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই। কালবেলার অমর স্রষ্টা সোমবার সন্ধ্যায় পাড়ি দিলেন চিরঘুমের দেশে,কালপুরুষের জগতে।৮১ বছর বয়সে। বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন অর্ক অনিমেষ-মাধবীলতার স্রষ্টা।এদিন সন্ধ্যা পৌনে ছটা নাগাদ কলকাতার বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারী হাসপাতালে স্তব্ধ হয়ে যায় প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিকের হৃদযন্ত্রের স্পন্দন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২৫ এপ্রিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারজয়ী সমরেশ মজুমদারকে ভর্তি করানো হয়েছিল। এর আগে ২০১১ সালে, গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় সাহিত্যিককে ভেন্টিলেশনও রাখা হয়েছিল।কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে তিনি ফিরে এসেছিলেন জীবনে, পুনরায় সচল হয়েছিল তার সৃজনী কলম।এর দশ বছর পরে, ২০২১-র নভেম্বরে তাকে ফের হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করাতে হয়েছিল।সে যাত্রাতেও ঘরে ফেরেন।তবে সেই থেকে সিওপিডি অর্থাৎ শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল লেখকের নিত্যসঙ্গী। এবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়তে থাকে।বেড়ে চলে স্লিপ অ্যাপেনিয়া (ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট)-র সমস্যা।দুইবার মৃত্যুকে জয় করে ঘরে ফিরে এলেও সোমবার চলে গেলেন না ফেরার দেশে।তার প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোকবার্তায় তিনি লেখেন, ‘বালা সাহিত্যের লব্ধপ্রতিষ্ঠ কথাকার সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণে সাহিত্য জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো।পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে ২০১৮ সালে বঙ্গবিভূষণ সম্মান প্রদান করে।আমি সমরেশ মজুমদারের আত্মীয়পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।’ সাহিত্যের অজস্র সম্মানে ভূষিত সমরেশের বিখ্যাত উপন্যাস ‘সোনার মোবাইল’ ২০১৬ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এর পূজা বার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়।
১৯৪২ সালে উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায় জন্ম।প্রাথমিক শিক্ষা জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে। ষাটের দশকের গোড়ায় তিনি কলকাতায় আসেন।ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজের বাংলা (সাম্মানিক) স্নাতক বিভাগে। এরপর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নিজের সৃষ্ট অক্ষরে ঘুরে-ফিরে তিনি উত্তরবঙ্গের সমাজ ও অনুষঙ্গকে ধরতে চাইতেন। লেখক সমাজের অনেকেই মনে করেন,সমরেশ মজুমদারের ট্রিলজি আদপে লেখকের আত্মজৈবনিক রচনা।তিনটি ভিন্ন নামে আদতে তিনটি খণ্ডে অনিমেষ মিত্র নামক চরিত্রের কৈশোর, যৌবন এবং প্রৌঢ়ত্বের অমোঘ ধারাবিবরণী। উত্তরাধিকার’ উপন্যাস অনিমেষ কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখার গল্প। মাধবীলতার সঙ্গে প্রেমের সূচনা।কালবেলা’য় অনিমেষ পুরোদস্তুর নকশাল।মাধবীলতা তার একমাত্র নোঙর।কালপুরুষ’-এ অনিমেষ পিতা। শারীরিকভাবে পঙ্গু মানসিকভাবে ভগ্ন।আর অনিমেষ-মাধবীলতার একমাত্র পুত্র অর্ক।কলকাতার নাগরিক জীবনে সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা নিয়েও সমান সচল থেকেছে তার সৃজন।সমরেশ-সৃষ্ট সাতকাহন,তেরো পার্বণ,স্বপ্নের বাজার,উজান,গঙ্গা,মেজরের অ্যাডভেঞ্চার,সোনার মোবাইল, গর্ভধারিণী,ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা,অনুরাগ- বাংলা সাহিত্যের আকাশে বহুকাল নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।১৯৭৫ – সালে প্রকাশিত সমরেশের প্রথম উপন্যাসের নাম ছিল ‘দৌড়’। সাদা পাতার উপর কালো অক্ষরের দীর্ঘ পরিক্রমার সেই দৌড় থেমে সোমবার।মৃত্যু জীবনের ভবিতব্য।কিন্তু সৃজনশীল মানুষেরা অবিনশ্বর হয়ে থাকেন তাদের কাজে।তাই সমরেশ মজুমদারের নশ্বর দেহ কাল,মঙ্গলবার পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেও রয়ে যাবে তার শাশ্বত কথামালা। বাংলাদেশ এবং ভারতের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক, বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কালবেলা’র স্রষ্টা সমরেশ মজুমদার মারা গেছেন।সহজ ভাষা এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাঙালির রোমান্টিকতা এবং মানবিক আবেক নিয়ে রচিত তার উপন্যাস দুই বাঙলার বাঙালি সমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার মৃত্যুতে ঢাকায়ও শোকের – ছায়া নেমে এসেছে।বাংলাদেশের উপন্যাস পাঠকদের সঙ্গে সমরেশ মজুমদারের – আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার উপন্যাস পাঠের মধ্য দিয়ে।তিনি তার জন্মভূমির পর বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষকে সবচেয়ে বেশি আপন মনে করতেন।কোন কোন সাহিত্য বিশ্লেষকের মতে তার উপন্যাস বাংলাদেশেই বেশি বিক্রি হতো। বাংলাদেশের মানুষের ডাকে তিনি যখন-তখন বাংলাদেশে চলে আসতেন।মিশে যেতেন পাঠক-লেখক-প্রকাশকের সঙ্গে। বাংলাদেশের একুশের বইমেলা তিনি -“কখনও মিস করতে চাইতেন না।প্রতি বছরই তিনি আসতেন একুশের বইমেলায়। “সমরেশ মজুমদারের মৃত্যুতে বাংলাদেশেও তার পাঠক-অনুরাগীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেক পাঠক ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সমরেশ মজুমদারের মৃত্যুতে বাংলা উপন্যাসের একজন মহানায়াকের বিদায় ঘটলো বলে শোক জানাচ্ছেন।