ছিল লাউ হলো গিটার!

 ছিল লাউ হলো গিটার!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

মানুষ তার ভাবুকতা, অন্বেষা ও সৃজনশীল শক্তিতেই সব গড়ে তোলেন। সভ্যতা সৃষ্টির সময় থেকে মানুষ তাদের এই প্রকৃতি অনুসারেই বহু কিছু গড়েছেন ভেঙ্গেছেন আবার নতুন করে গড়েছেন। গড়ে ওঠেছে, আবার রুপান্তরের মাধ্যমে এসেছে নতুন সংস্কৃতি, এবং অন্তহীন বিজ্ঞান এর সাধনার ফল গড়ে তুলেছে কত কত সভ্যতা| সংস্কৃতি আর বিজ্ঞান যেন ভাঙ্গাগড়ার আবিস্কারের মাধ্যমেই প্রতিদিন নতুন কিছু উপহার দিয়ে চলেছে। আবার, এসব ঘটে যাবার পর্দার আড়ালে কোথাও কোথাও পরা ও অপরা বিজ্ঞানও এসে হাত ছুঁয়ে যায়| ফিজিস্কের শিক্ষক পঙ্কজ দাশও পদার্থবিদ্যা নিয়ে তাঁর অনুশীলন আর অন্বেষার পরিক্রমায় কখনো হাত বাড়িয়ে দেন মেটা ফিজিক্সের দিকে।
  দু’ বছর আগে, কোভিড আক্রান্ত হয়ে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি থেকে পঙ্কজ  মৃত্যুর পদচারনাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তাঁর কথায়, হাসপাতালে তার পাশের বেড গুলো  খালি হওয়ার চাবিগুলো তো শুধু চাবি ছিল না! আশংকা, আফসোস ও ইচ্ছে নাগারে ভাবিয়ে যেত – শব্দবিজ্ঞান আর মননের সুরালোকের চেতনায় সঞ্জীবিত যে গম্ভীর মূর্ছনা বেজে চলেছে মনের গভীরে, সে কি আর দিনের আলো দেখবেনা!! এই জন্যই তো আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। জীবনীশক্তি যেন সেই থেকে তাগড়া হয়ে ওঠে আর কিছু দিনের মধ্যেই সুস্থ শরীরে বাড়ি আসি| সব দিনের সমস্ত রুটিন কাজের মধ্যে মনোজগতের বিরাট অংশে তখন জায়গা করে নিয়েছে নতুন যন্ত্রের প্রসব যন্ত্রণা| পঙ্কজ দাশ যেন সকুমার রায় এর “ছিল লাউ হলো গিটার!” এর সফল উদ্ভাবন করলেন। 
  ছোটবেলায়, বোনের তানপুরা তারে যাতি দিয়ে সুর তুলতেন হাওয়াইন গিটারের মতো। তানপুরা‌ সোনোমিটার হয়ে থাকলেও একদিন স্কুল পড়ুয়া ছেলেটি গিটার শিল্পী প্রবীর করের কাছে পৌঁছে যায়‌। পঙ্কজ এই প্রতিবেদক কে বলেন, আকাশবাণীর পার্থ বসুর কাছ থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিতে নিতে  রাজ্য ব্যাপী সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় দুবার অংশ নেন, এবং দুবারই প্রথম স্থান অর্জন করেন| সেই সময়ই, তিনি তাঁর বাবাকে হারান আর তালিমেও ভাটা পড়ে। কিছুদিন পর, তিনি  পন্ডিত ব্রিজভূষণকাবরা, পন্ডিত বিশ্বমোহন ভাট এবং পন্ডিত দেবাশীষ ভট্টাচার্যের বাজনার প্রতি ভীষণ আকর্ষণ অনুভব করতে থাকেন| তাঁদের বাজনা শুনে হাওয়াইন গিটারে ক্ল্যাসিক্যাল চর্চায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। এরমধ্যে ১৯৯৪ এর শেষে যুবউৎসবে যোগ দেন এবং ওই সাথে তাঁর সামনে ক্ল্যাসিক্যাল গিটারের এক অন্য দুনিয়া খুলে যায়। এযাবৎ বহু সঙ্গীত অনুষ্ঠানে তিনি গিটারের অনবদ্য সুরের মূর্ছনা পরিবেশন করেছেন| অনেক দিন আগেই হয়ে ওঠেছেন রাজ্যের একজন বিশিষ্ট গিটার বাদক।
  আকাশবাণী আগরতলা, দূরদর্শন আগরতলার নিয়মিত শিল্পী হওয়ার সাথে সাথে, বিভিন্ন মঞ্চ অনুষ্ঠান, যুব উৎসব, সঙ্গীত নাটক একাডেমীর অনুষ্ঠান এবং কলকাতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বহু  অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর সুরের লহরী দর্শকদের সামনে পরিবেশন করেছেন। ২০০৭-২০০৮ সালে দৈনিক সংবাদ ও এয়ার ইন্ডিয়ার যৌথ আয়োজনে বোল্ট এওয়ার্ড সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে নানা পুরস্কার লাভ করলেও মনের গভীরের কোথাও, একটা অন্য কিছু যেন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। একটা সুরের খোঁজে পাক যাচ্ছিল তাঁর মন ও সময়।
 সেই সুর  নিয়ে যায় ফিজিস্ক থেকে মেটাফিজিস্কে অর্থাৎ অপার্থিব জগতে। ফিজিস্ক পড়ানো পেশা হলেও, পঙ্কজের সাধনায় থাকে সঙ্গীত চর্চাও। সেই সুত্র ধরেই, গীটারের আদল তৈরির উপকরণ  নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে শুরু করেন। গিটারের চিরন্তন আদল ও উপকরণে  পরিবর্তন করার কথা কি ভাবনা থেকে আপনার মাথায় এলো? সুকুমার রায়ের ভাষায় বলতে হয় “ছিল লাউ হলো গিটার”। পঙ্কজবাবুর মতে, সনাতন মার্গসঙ্গীতে যন্ত্রগুলির মধ্যে তানপুরা, সুরবাহার, সেতার তৈরি হয় লাউ দিয়ে।এছাড়া একতারা, দোতারা, ডুগডুগি এবং আরো কিছু লোকবাদ্য যন্ত্র তৈরি হয় লাউ দিয়েই। কিন্তু হাওয়াইন গিটার প্রধানত পাশ্চাত্য সংগীতের জন্য ব্যবহৃত হলেও, এই যন্ত্রটি ভারতীয় মার্গসঙ্গীতেও ব্যবহৃত হয় বহুল পরিমাণে। কিন্তু, লাউ দিয়ে গিটার তৈরী হয়নি| কি জানি কেন, আরো অনেক ভারতীয় যন্ত্রের মত গিটারও লাউ দিয়ে  বানানোর একটা অদম্য ইচ্ছা আমার মনের মধ্যে কাজ করছিল | কিন্তু কে বানাবেন? নিজেকেই প্রশ্ন করেন তিনি| পঙ্কজ বলেন, ফর্মুলাটা আমি তো বলে দিতে পারব কিন্তু তৈরী করার টেকনিক তো আমার জ্ঞানের বাইরে আর আমার পক্ষে সম্ভবও নয় | তাই কলকাতার একজন বীণা  প্রস্তুতকারকের শরণাপন্ন হই। যিনি বীণার সাথে সেতার, সুর সিংগার, সুরবাহার ইত্যাদি বানাতে পারেন। এবং অনেক করে তাকে রাজি করানোর পর তিনি এই যন্ত্র তৈরি করেও ফেলেন, সফলভাবে। এবার তিনি বলেন, এটা বানানোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতীয় সনাতন যন্ত্রের আদলে গিটার কেও মার্গ সঙ্গীতের উপযুক্ত করে তোলা।
 এই গিটারের অবয়ব ও আকৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে পঙ্কজবাবু জানান, লাউ দিয়ে বানানো গিটারে তরব(মূল তারের নিচে রাখা কতগুলো সরু তার মূল তারে বিভিন্ন স্বর বাজালে ওই তার গুলো অনুনাদ এর ফলে বাজতে থাকে এতে পুরো বাজনা শ্রুতি মধুর হয়)সহ মোট ২২টি তার আছে, একটি তুম্বা(একখানি ছোটো লাউ যা সেতার সরোদের মতো বিভিন্ন যন্ত্রের অগ্রভাগে থাকে), সামনে এবং পেছনে চিকারী (মূল তারের সঙ্গে লাগানো অতিরিক্ত দুটি তার একটি নিচের সাথে অপরটি উপরের সাথে বাঁধা থাকে যন্ত্রে বিভিন্ন স্বরের স্হায়িত্ব কাল বাড়াতে সাহায্য করে#) আছে। এতে সেতার সরোদের মত তরবের তার থাকে। তারের গেজ অন্যান্য সাধারণ গিটারের মত নয়। এতে জার্মানি তার ব্যবহার করা হয়। ফ্রেট(কত গুলো দাগ বা নির্দেশক চিহ্ন যা প্রাথমিক অবস্থায় স্বরকে চিনতে সাহায্য করে)বোর্ডের নীচের জায়গাটা খালি থাকে – অনেকটা সেতারের মতো।
তিনি জানান, এর আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এতে সাধারণ গিটারের মতো কোন গর্ত থাকেনা। তবলীর পাটাতনের কম্পনের ফলে শব্দ সৃষ্টি হয়। পঙ্কজ বাবুর কথায়, যা তরব সহ সব তারের অনুসরণের ফলে একটি গুরুগম্ভীর শব্দ সৃষ্টি হয়। এ এক অন্য সুর ও অনবদ্য মাত্রা এনে দেয়| এই সুর কোনভাবেই সাধারণ গিটারে পাওয়া যায়না।
 পঙ্কজ বাবু মনে করেন, ফিজিক্সের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে গিটার বাজানোর সুরকে এক অনুপম মাত্রা দিতে তিনি সুফল পেয়েছেন। তবে, স্প্যানিশ, অ্যাকুয়াষ্টিক গিটারের যুগে এই ভারী যন্ত্র কতটা জনপ্রিয় হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মার্গ সঙ্গীত নিয়ে যারা কাজ করেন, যারা সুরের সাধনায় নিমগ্ন থাকেন, এই ভাবনাটা তারা দেখবেন। এই লাউ-গিটারের মূল্য্য ৩৫ হাজার টাকা। এর আভিজাত্য সঙ্গীত সাধকদের আকৃষ্ট করবে বলেই বিশ্বাস করেন পঙ্কজ বাবু। তাঁর অটল বিশ্বাস বিজ্ঞান আর সুরের সাধনায় রত এক বিজ্ঞান শিক্ষককে সুরের সৃষ্টি কর্তা, স্বয়ং জীবনদেবতার আশীর্বাদই তাঁকে ফিজিস্ক থেকে মেটা ফিজিক্সের নদে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন, সুরের তালে তালে ভেলায় পাল দিচ্ছেন।

——নন্দিতা দত্ত

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.