জগন্নাথ দেবের পূজা মর্ত্যে কীভাবে শুরু হয়।
আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের পুষ্যা নক্ষত্র যুক্ত দ্বিতীয়া তিথিতে বলরাম ও সুভদ্রা সহ জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা হয়। প্রভু জগন্নাথ দেব এই দিনে দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে নিয়ে মাসির বাড়ি যান। পুরীতে মাসির বাড়ির নাম গুন্ডিচা মন্দির। আবার মাসির বাড়িতে সাত দিন কাটিয়ে শ্রী জগন্নাথ দেব তাঁর প্রিয় খাবার ‘পোড়া- পিঠা’ খেয়ে ফিরে আসেন নিজের বাড়িতে। আর তার মাসির বাড়ি থেকে ফিরে আসার দিনটিকে উল্টো রথ বলা হয় । এই ঘটনাটুকুই সাধারণ ভাবে আমাদের সামনে রথযাত্রার বিবরণ। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব । ওড়িশার পুরী এই উৎসবের মূল অধিষ্ঠান হলেও বর্তমানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেই রথযাত্রার প্রচলন শুরু হয়ে গেছে। শ্রী জগন্নাথ দেব ও তাঁর দুই ভাইবোন বলরাম এবং সুভদ্রাকে দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে পুরীতে। রথের রশি টানতে, ছুঁতে বা রথের চাকার দাগকে স্পর্শ করতে ।জগন্নাথ দেবের পূজা মর্ত্যে কীভাবে শুরু হয় : এই কাহিনির উৎস দ্বাপর যুগের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পর থেকে। কৃষ্ণের মৃত্যুর পর অর্জুন তাঁর দেহ সৎকারের শেষে দেখেন, কৃষ্ণের দেহ সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়ে গেলেও তাঁর হৃৎপিণ্ড তখনও নীল হয়ে জ্বলছে। তখনই হল দৈববাণী, ‘ইনিই সেই পরমব্রহ্ম। অর্জুন, এঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। সমুদ্রেই ওঁর অনন্তশয়ন।’ অর্জুন তাই করলেন। ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল পরমব্রহ্ম সেই নাভি। অর্জুন সেই জ্বলন্ত হৃৎপিণ্ড জলে ভাসিয়ে দিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন। ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল সেই উজ্জ্বল নীলবর্ণের নাভি। এরপর এল কলি যুগ। কলিঙ্গের রাজা তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত। তিনি গড়ে তুললেন একটি মন্দির, শ্রীক্ষেত্রে। কিন্তু সেই মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই! এরপর একদিন সমুদ্রের জলে স্নান করার সময় তিনি দেখেন, একটি নরম লোহার টুকরো ভেসে যাচ্ছে। তিনি লোহার টুকরোটি হাতে নিতেই এক দৈববাণী শুনতে পান, ‘এই নরম লোহার টুকরোটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হৃদয় এবং এটি পৃথিবীতে বরাবরের জন্য থাকবে। এই টুকরোটি যেন জগন্নাথ দেবের মূর্তির মধ্যেই স্থাপন করা হয়। আর এমনভাবে এটি করতে হবে, যাতে তা কোনওদিন কারোর নজরে না-আসে। নীলমাধব রূপে তাঁর কাছে আসতে চান ভগবান।” শুনেই রাজা শিহরিত হলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে চারদিকে লোক পাঠালেন। সকলেই ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান। কিন্তু একসময় সকলেই খালি হাতে ফিরে এলেন রাজার কাছে। ফিরলেন না শুধু একজন তিনি বিদ্যাপতি। নীলমাধবের মূর্তি খুঁজতে খুঁজতে জঙ্গলের মধ্যে পথ হারালে তাঁকে উদ্ধার করলেন এক সুন্দরী শবর কন্যা ললিতা। নিয়ে এলেন তাদের বাড়ি। ললিতার প্রেমে পড়লেন বিদ্যাপতি। বিয়ে হল দু’জনের। ললিতা শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা। বিয়ের পর বিদ্যাপতি লক্ষ্য করলেন, রোজ সকালেই শবররাজ বিশ্ববসু কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও উধাও হয়ে যান, আবার ফিরেও আসেন। কৌতূহলী হন বিদ্যাপতি। কোথায় যান বিশ্ববসু তা জানতে পিছু নিলেন একদিন। দেখলেন, জঙ্গলের মধ্যে একটি গোপন জায়গায় নীলমাধবের পুজো করতে যান শবররাজ বিশ্ববসু। চমকে গেলেন বিদ্যাপতি। মনে পড়ল তাঁর রাজকর্মের কথা। নীলমাধবের মূর্তি খুঁজতেই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব তাঁকে নিয়োগ করেছিলেন। সেই নীলমাধবের সন্ধান যখন পাওয়া গেছে, তখন আর হাতছাড়া করা সম্ভব নয়। সেই সময় ঘটল আর এক ঘটনা। শবররাজ বিশ্ববসু যখন পুজো করছিলেন তখন দৈববাণী হল,
‘এতদিন আমি দীন-দুঃখীর পূজো নিয়েছি, এবার আমি মহাউপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজো নিতে চাই।’ বিদ্যাপতিও সঙ্গে সঙ্গে এই খবর পৌঁছে দিলেন রাজার কাছে। নীলমাধব যখন স্বয়ং রাজা ইন্দ্রদুন্ন্যের পুজো নিতে চান, তখন কী আর দেরি করা যায়? রাজা বিস্ময়ে মহানন্দে সব ব্যবস্থা করে হাজির হলেন
জঙ্গলের মাঝে নীলমাধবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছনো মাত্রই সেই মূর্তির কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। তখন আবার দৈববাণী শোনা গেল, ‘সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে যে কাঠ সেই কাষ্ঠখণ্ড থেকেই তৈরি হবে বিগ্রহ’। সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎই একদিন সমুদ্রের জলে কাঠ ভেসে এল। মহাসমারোহে শুরু হল বিগ্রহ তৈরির কাজ কিন্তু কীভাবে তৈরি হবে? ভেসে আসা কাঠ এমনই শক্ত যে মূর্তি গড়া সম্ভব হল না কারও পক্ষে। তাহলে মূর্তি গড়বে কে? মহারাজ আবারও পড়লেন বিপদে। দিশাহারা হয়ে উঠলেন। ইন্দ্রদ্যুম্নের সেই অসহায় অবস্থা দেখে বুঝি এবার দুঃখ হল ভগবানের। শিল্পীর রূপ ধরে স্বয়ং জগন্নাথ এসে দাঁড়ালেন রাজপ্রাসাদের দরজায়। বললেন, তিনিই গড়বেন ভগবানের বিগ্রহ। তবে তার একটি শর্ত আছে, শর্তটি এমন যে তিন সপ্তাহ বা ২১ দিনের পূর্বে কেউ তাঁর কাষ্ঠমূর্তি নির্মাণ দেখতে পারবে না। অতঃপর শর্তানুযায়ী কাজ আরম্ভ করলেন দারুশিল্পী। কিন্তু ইন্দ্রদ্যুম্নের রানি গুন্ডিচার তর সইল না। একদিন ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ না পেয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন এবং দেখলেন, কারিগর উধাও! সঙ্গে তিনটি অর্ধসমাপ্ত মূর্তি ! অসমাপ্ত মূর্তির না আছে হাত, না আছে পা। অনুশোচনায় কাতর হলেন রাজা-রানি দু’জনেই। ভাবলেন, শর্ত খণ্ডনের ফলেই জানতে বুঝি এত বড় শাস্তি পেলেন তারা। আর সম্পর্ণ না-হলে তা পুজো হবে কীভাবে?
ঠিক তখনই নারদ মুনির আবির্ভাব হয়। তিনি রাজাকে জানান যে, এই রকমই এক অর্ধসমাপ্ত মূর্তি দেবতাদের স্বীকৃতিস্বরূপ তাই সেই মূর্তির পুজো করলে তা মর্ত্যেও স্বীকৃতি পাবে। নারদের কথা শুনে রাজা তখন সেই অর্ধসমাপ্ত মূর্তির পুজো শুরু করেন। সেই সঙ্গে সমুদ্রে ভেসে আসা নরম লোহার টুকরোটি জগন্নাথ মূর্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেন। এমনভাবে স্থাপন করেন, যা আজ পর্যন্ত সকলের দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে। এই হল জগন্নাথ দেবের ইতিহাস।