জয়তু ভারত!!
অনলাইন প্রতিনিধি :-দেশজুড়ে আলোর উৎসব দীপাবলির দিন উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা-
বারকোট সুরঙ্গের মধ্যে নিকষ আঁধারে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন ৪১ জন শ্রমিক।সতেরো দিনের,আরও নির্দিষ্ট করে বললে ৪২০ ঘন্টার বন্দিদশা কাটিয়ে,মরণপণ লড়াইশেষে মুক্ত হয়েছেন সকলেই। অক্ষত শরীরের ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরেছেন,এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে স্বস্তির খবর।অক্লান্ত পরিশ্রমী উদ্ধারকারীদের জন্য কোনও সাধুবাদই যথেষ্ট নয়।তাদের সদিচ্ছা,একাগ্রতা,মানুষের প্রতি তাদের ভালবাসাকে সমগ্র জাতি কুর্নিশ জানায়। এই জয় ভারতীয় সংহতি ও অগ্রগতির।এই জয় বিজ্ঞানের,প্রগতির।এই জয় ভারতমাতার।ভগবানের আগমনের পথ প্রশস্ত করতে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ চলছিল উত্তরকাশীর ওই স্থলে।অথচ কোনও ঐশী শক্তির বদলে সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করার জন্য জানু ভাঙতে হল সেই বিজ্ঞানের সামনে।কোনও দৈবশক্তিতে উদ্ধারকাজ সম্ভব হয়নি,সম্ভব করেছে মানুষের ভালবাসা,নিষ্ঠা,অধ্যবসায়। এমনকী মেশিন যা পারেনি, তা সাধ্য করেছে প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের হাত। বিদেশি সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিস্ক গত এক সপ্তাহ ধরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেভাবে জান কবুল করে নিজের একাগ্রতায় মগ্ন ছিলেন,মরণোন্মুখ শ্রমিকদের উদ্ধারে স্থিতপ্রজ্ঞ ছিলেন,তার জন্য কোনও অভিনন্দনই যথেষ্ট নয়।গত কয়েক বছর ধরে হিমালয় পার্বত্য এলাকার ‘উন্নয়নের দূষণ’ নিয়ে নানা স্তরে যে আলোচনা চলছে, সিল্কিয়ারার এই দুর্ঘটনা নিঃসন্দেহে তাকে আরও জোরালো করেছে।উন্নয়ন কাকে বলে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদ,সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা মত আছে। কেবলমাত্র আর্থিক অগ্রগতিকেই উন্নয়ন হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া যায় কি না, তা নিয়েও বিস্তর বিতর্ক আছে।এ কথা না বলে উপায় নেই যে,গত দু’দশক ধরে যে সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট বা সুস্থায়ী উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে,পাহাড় ধ্বংস করে তথাকথিত উন্নয়নের পথ তৈরির অবস্থান কিন্তু তার বিপরীতে।উন্নয়নের নামে পাহাড়কে যদৃচ্ছ ব্যবহার করলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। গঠনগত ভাবে এমনিতেই হিমালয়ের ভূপ্রকৃতি ভঙ্গুর। ফলে এই অঞ্চলে যেকোনও পরিকাঠামো গড়তে অঞ্চলের ধারণক্ষমতা যাচাই এবং তার সাপেক্ষে যথোপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি।পার্বত্য অঞ্চলে পরিকাঠামো নির্মাণ অবশ্য সাম্প্রতিক ঘটনা নয়, ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে সামরিক ছাউনি সহ নানা নির্মাণ চলে এসেছে।কিন্তু গত কয়েক দশকে ভারত-চিন দুই দেশের দৌলতে সেই প্রয়াস বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাহাড় জুড়ে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় গড়ে উঠেছে নতুন সরকারী ভবন, অপরিকল্পিত বাজার, বহুতল, ঘিঞ্জি সড়ক। ন্যূনতম সুরক্ষাবিধি কতটুকু মানা হচ্ছে তা নিয়েও নিয়ত প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশবিদরা। এতদসত্ত্বেও প্রস্তাবিত চারধাম প্রকল্পের অঙ্গ হিসাবে পর্যটন স্থলে গড়ে উঠেছে হেলিপ্যাড, যা হিমালয়ের মতো নরম মাটির পার্বত্য অঞ্চলের পক্ষে বিপজ্জনক।পাশাপাশি, পাহাড়ি নদীকে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে বেঁধে স্বাভাবিক জলধারাকে নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে।ভূমিধসে ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। একা ভারত নয়, হিমালয়ের স্বাভাবিক চরিত্র হননে চিনও সমধিক দায়ী।সুস্থিত প্রকৃতির স্বার্থে, পরিবেশের স্বার্থে, সর্বোপরি জনস্বার্থে, প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে বিরত রাখা আদতে ভারতের দায়বদ্ধতার মধ্যেই পড়ে। অন্তত এই একটি বিষয়ে বৈরিতা দূরে সরিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র চিনের সঙ্গে ভারতের সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তোলা আবশ্যিক।কারণ প্রকৃতির সতর্কবার্তায় কর্ণপাত না করলে হিমালয়ের সঙ্গে প্রকৃতির চরম রোষানলে পড়বে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রেরই বিরাট জনসমাজ।দেশের কৃতিত্বকে কোনও অংশে খাটো না করে এ কথা বলতেও দ্বিধা নেই যে, উত্তরকাশীর ঘটনা আমাদের সামনে আরও একটি বিষয় প্রাঞ্জল করেছে, তা হল এ দেশের কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তাও হিমালয়ের ভূপ্রকৃতির মতোই ভঙ্গুর। ফলে, স্বস্তির আবহেও এমন প্রশ্ন অবধারিতভাবে উঠবে যে, কার স্বার্থে, কাদের লাভের কথা ভেবে ভূবিজ্ঞানীদের বারংবার সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে, হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে প্রস্তাবিত চারধাম প্রকল্প নির্মাণের ঝুঁকি নিয়েছে রাষ্ট্র?তবে এত প্রশ্নের পরেও পরিশেষে বলার, সুশাসন নীতি মেনে শাসক রাজ্যপাট চালালে প্রজারা নিরাপদ থাকেন।সুড়ঙ্গের মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা ৪১ জন শ্রমিক নিশ্চয়ই এর কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।