জল ও খাদ্য ছাড়া বেঁচে ছিলেন ৭৬ বছর
পরনে লাল শাড়ি । পিঠ পর্যন্ত সাদা চুল । কপালে লাল টিপ । সিঁথিজুড়ে টকটকে লাল সিঁদুর । নাকে সোনার নথ । গলায় সোনার গয়না । কানে দুল । না , তিনি মহিলা নন । পুরুষ । দীর্ঘ ৭৬ বছর ধরে এই পরিধানেই ভক্তরা তাকে দেখেছেন । তার থেকেও আশ্চর্যের বিষয় , গত ৭৬ বছর তিনি দাঁতে কিছু কাটেননি । তিনি নাকি স্রেফ হাওয়া খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন জীবনের শেষ সাড়ে সাত দশক । মা অম্বার সাধক ছিলেন ।
আদ্যন্ত এক প্রহেলিকাময় জীবন ছিল তার , যে রহস্য এখনও কেউ উন্মোচন করতে পারেননি । এমন বেশভূষার জন্যই ভক্তরা তাকে ‘ মাতাজি ’ বলে সম্মোধন করতেন । ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘ চুনরিওয়ালা মাতাজি ’ নামে । দেশজুড়ে করোনার লকডাউনের সময় গুজরাটের গান্ধীনগরে চারাদা গ্রামে ৯০ বছর বয়সে শেষ ‘ দেহ রাখেন ‘ মাতাজি ।। তার আসল নাম ছিল যোগী প্রহ্লাদ জানি । প্রকৃত সাধকের জীবন যেমন হয় , তেমনই জীবনযাপন ছিল তার । ভক্তবৃন্দ দাবি করেন , শেষ ৭৬ বছর মাতাজি স্রেফ হাওয়া খেয়ে বেঁচে ছিলেন । খাবার তো দূরের কথা , জলও স্পর্শ করতেন না তিনি ।
চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে , কোনও মানুষ জল না খেয়ে দশ পনেরো দিনের বেশি বাঁচতে পারেন না । কিন্তু এই সন্ন্যাসী কী করে বেঁচে ছিলেন , চিকিৎসকদের কাছে আজও তার কোনও ব্যাখ্যা নেই । আমেরিকা , জার্মানি , অস্ট্রিয়ার একাধিক গবেষক মাতাজির বেঁচে থাকার রহস্য নিয়ে গবেষণা করেছিলেন । বিভিন্ন রিপোর্টে তারা জানিয়েছিলেন , লেনামোরোলিন এবং লেফটিন হরমোনের উপস্থিতির ফলে মানুষের খিদে পায় । মাতাজির শরীরে এই দুই হরমোনের কার্যত অস্তিত্ব ছিল না । ফলে তার খিদে পেত না ।
ভক্তরা বলেন , মাতাজির জিভের মাঝে অদ্ভুত এক ছিদ্র ছিল । আর মাতাজি বলতেন , ওই ছিদ্র দিয়েই স্বয়ং মা অম্বা তাকে খাবার দেন । তাই আলাদা করে তার আর কিছু খাওয়ার দরকার পড়ে না । আমদাবাদ ২০০ কিলোমিটার দূরে বানসকাঁঠা জেলার অম্বাজিতে আশ্রম ছিল তার । সেখানে চুনরিওয়ালা মাতাজি নামেই পরিচিত ছিলেন প্রহ্লাদ জানি ।
তার জন্ম হয়েছিল চারদা গ্রামে । সাত বছর বয়সে বাবা মাকে ছেড়ে জঙ্গলে চলে যান তিনি । শুরুতে আম্বাজি মন্দিরের কাছে ছোট একটি গুহায় থাকতেন । পরে সেই গুহাই হয়ে ওঠে তার আশ্রম । সেখানেই যোগী হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতি পান । দেবী অম্বার ভক্ত হওয়ায় তিনি লাল শাড়ি পরে থাকতেন । পুরুষ হলেও মহিলাদের মতোই বেশভূষা ছিল তার । কপালে লাল টিপ পরতেন আর সিঁথিতে পরতেন সিঁদুর । গলায় থাকত লাল চুরনি বা ওড়না । ভারতের বাইরেও মাতাজির বহু ভক্ত রয়েছেন ।
ভক্তরা বলেন , ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত আর পাঁচটা ছেলের মতোই খাবার খেতেন তিনি । ১৯৪০ সাল থেকে শেষ দিন পর্যন্ত এক দানা খাবার কিংবা এক বিন্দু জলও তিনি মুখে দেননি বলে দাবি করা হয় । ভক্তদের এমন বিশ্বাসেরও কারণ আছে ।২০০৩ সালে ১১ জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে বোর্ড গঠন করে ধারাবাহিক ভাবে মাতাজির শরীরে পরীক্ষা – নিরীক্ষা চালানো হয় । কিন্তু সেই বোর্ড মাতাজির না খেয়ে বেঁচে থাকার রহস্য ভেদ করতে পারেনি । এপিজে আবদুল কালাম রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ে দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও এবং কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োজিত বিজ্ঞানীরা ২০১০ সালে টানা ১৫ দিন ধরে যোগী প্রহ্লাদের উপরে নজরদারি চালিয়েছিলেন ।
ওই সময় এমআরআই থেকে আলট্রাসোনোগ্রাফি , এক্স- ইত্যাদি কিছুই বাকি রাখা হয়নি । এমনকী সূর্যের আলোয় টানা বসিয়ে রেখে পরীক্ষা করা হয় মাতাজির শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন । রক্তে লেপটিনের পরিমাণও মাপা হয় । কারণ মাস্টার হরমোন লেপটিনই নিয়ন্ত্রণ করে দেহের ওজন । সেবারেও মাতাজির শরীরের রহস্য উন্মোচন করতে ব্যর্থ হয় চিকিৎসা বিজ্ঞান ।। ভক্তরা বলেন , মাতাজি কোনও কিছু না খেলেও নিয়মিত যোগাসন করতেন । ১৮ বছর বয়স থেকে মৃত্যুর দু’দিন আগে পর্যন্ত কোনও দিন তার যোগ্যাভ্যাসে ছেদ পড়েনি । ভক্তবৃন্দ বলেন , মাতাজি করতেন যোগাসন এবং বায়ু – সাধনা । যার জেরে এত বছর ধরে কোনও কিছু দাঁতে না কেটে , জলস্পর্শ না করেও সুস্থ , স্বাভাবিক জীবন কাটিয়ে গেছেন । বিগত সাড়ে সাত দশক ধরে তিনি ছিলেন এক জীবন্ত প্রহেলিকা ।