জল যন্ত্রণা

 জল যন্ত্রণা
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

সবে তো এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধ। এরই মধ্যে চড়ছে তাপমাত্রার পারদ। মে-জুন মাস তো এখনও অনেকটা বাকি। তবুও চাতকের মতো চেয়ে থাকা আকাশের দিকে। কবে হবে বৃষ্টি। কবে ভিজবে মাটি। প্রবল তাপপ্রবাহে মানুষের এরই মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। জল নেই। আছে তৃষ্ণা। সর্বত্রই কেবল জলসংকট। গ্রীষ্মের তাপদাহে জলস্তর নেমে যাওয়ায় এমনিতে গ্রাম-পাহাড়ে নদী-নালা-পুকুর শুকিয়ে কাঠ। সামান্য রান্নার জল কিংবা পানীয় জল কিছুই মেলে না তখন। কিন্তু প্রত্যন্ত পাহাড় কিংবা দুর্গম জনপদ বাদ দিলে, সাধারণ গ্রাম ত্রিপুরায় যখন এই এপ্রিলের প্রথমার্ধেই জলের জন্য হাহাকার শুরু হয়ে যায় তখন স্বাভাবিক কারণে মনে প্রশ্ন আসে, বছর ঘুরে একই সংকট বারবার যদি প্রশাসনের দরজায় কড়া নাড়ে তাহলে সরকার এতগুলো বছর কোথায় ছিল? শামুকের খোলসের ভেতর শরীরটাকে লুকিয়ে রাখলেই কি তবে সবকিছু আড়াল করা যায় ?
অনেকদিন আগে একটা প্রবন্ধে লেখক বলছিলেন, কল আসছে, কিন্তু জল আসবে তো? আমাদের রাজ্যের পরিস্থিতিটাও ঠিক এ রকমই। ভূগর্ভস্থ জলস্তর মাত্রাতিরিক্তভাবে কমে যায় প্রতি বছর। যে কারণে বাড়ি ঘরে কিংবা পঞ্চায়েতের ব্যবস্থায় যে নলকূপ বসানো আছে সেগুলো থেকে জল উঠে না।

Ground Report: A Custodial Death, a Protest and Raids that Drove Dalit  Villagers Out of Homes


তখন তাদের পুকুরের জলেই সারতে হয় স্নান, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, এমনকী শৌচকর্মও। কিন্তু এটা না হয় শহর লাগোয়া গ্রামাঞ্চলের ছবি। বাজার থেকে পানীয় জল কিনে শহরের মানুষ হোক নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত, তারা – বছরের পর বছর এভাবেই জীবনের জয়গান গেয়ে চলেছেন। কিন্তু গ্রামে এসব সম্ভব নয়। প্রতিদিন যদি পানীয় জল তাদের কিনে খেতে হয় প্যাকেটজাত বোতলের মাধ্যমে, তাহলে তো তাদের নাভিশ্বাস দশা। কিন্তু পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে, যখন গ্রাম-শহর পেরিয়ে দুর্গম এলাকায় এই গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে পানীয় জলের সংকটের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। রাজ্যের অতিদুর্গম, প্রত্যন্ত এলাকা বলে পরিচিত, ধলাই জেলা, উত্তর জেলা কিংবা উনকোটি জেলার কোনও তৃষ্ণার্ত মানুষের ভয়াবহ দিনযাপনের খবর নয়। রাজধানী আগরতলা শহর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মান্দাই ব্লকের শিবসর্দার পাড়ার মানুষের দৈনন্দিন জলকষ্টের এক অসহনীয় খবর প্রমাণ করে দেয় গ্রাম-পাহাড়ে বাস্তবিক অর্থে মানুষ জীবনযুদ্ধে কার্যত দিশাহীন। শিবসর্দার পাড়ার ৪০ থেকে ৪৫ পরিবারের দুই শতাধিক মানুষ জলসংকটে ভুগছেন।


গ্রামের রমণীদের উঁচু টিলা বেয়ে দূরদূরান্ত থেকে জল সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী বিশ্বমণি পাড়ায় একটি জলের উৎস রয়েছে। সেই জলের পাম্প থেকেই শিবসর্দার পাড়ায় পানীয় জল সরবরাহ করা হয়। বিশ্বমণি আর শিবসর্দার পাড়ার দূরত্ব ১ কিলোমিটার। ফলে মেশিন চালিয়ে এত দূরত্বে জলের ধারা স্বাভাবিক রাখা যায় না। বাধ্য হয়েই এবড়োথেবড়ো, উঁচু-নিচু পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জল সংগ্রহ করতে হয় তাদের। এ তো গেলো জল তেষ্টার কষ্ট। এছাড়া জলের আরেক আতঙ্কও রয়েছে শিবসর্দার পাড়ার মানুষের। বর্ষায় চলাফেরা করতে গিয়ে বিকল্প কোনও সড়ক নেই এই গোটা গ্রামের। ফলে বর্ষার সময় উঁচু পাহাড় টিলার রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে বিপদসংকুল চেহারা নেয়। ঝড় জলের কারণে প্রায়শই থাকে না বিদ্যুৎ সংযোগ। তখনও উঁচু টিলার চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জল সংগ্রহ করতে গিয়ে বিপদসংকুল রাস্তার পেছনে বহু মানুষ আহত হয়েছেন। কেউবা ছিঁড়ে পড়া বিদ্যুতের তারের সংযোগে এসে তড়িদাহত হয়েছেন। এভাবেই এক জলসংকট, নানাভাবে শিবসর্দার পাড়া এলাকায় বহুমাত্রিক আতঙ্ক আর দুর্ভোগ তাদের জীবনে নিত্য বিডম্বনা তৈরি করছে। তাই জল নিয়ে আতঙ্ক কাটে না কিছুতেই।
কখনও জলতৃষ্ণা, কখনও পাহাড়ের সরু রাস্তা থেকে পিছলে পড়ে যাওয়া, আবার কখনওবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া। এভাবেই জল নিয়ে যন্ত্রণা, দুর্ভোগ, শঙ্কা আর তৃষ্ণার জীবন কেটে যায় শিবসর্দার পাড়ার মানুষের। অথচ যাদের দরজায় প্রতি পদক্ষেপে দুর্যোগ হাতছানি দিয়ে বেড়ায় তাদের জন্য রাজ্য প্রশাসন, এডিসির কর্তৃপক্ষ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো সবাই নির্বাক। যাদের দৈনন্দিন জীবনে জলই হাজারো সমস্যা, তারা তবু ভোটের লাইনে দাঁড়ায়, ভোট দেয় ভোগান্তি সমাধানের আশায়। কিন্তু সেই সংকট মেটে না।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.