জাতিসুমারি বিতর্ক

 জাতিসুমারি বিতর্ক
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

২০২১ সালের নির্ধারিত জনগণনা, এখনও এ দেশে কার্যকর করা যায়নি। এর পেছনে কারণ হচ্ছে অতিমারির ভয়াবহ পরিস্থিতি। কথা ছিল ‘২১- এর জনগণনায় মোট ৩১ ধরনের প্রশ্ন করে তথ্য সংগ্রহ করা হবে আদমসুমারিতে। আপনার বাড়ি কি নিজের ? নাকি ভাড়া থাকেন ? বাড়িতে কটা পরিবার? ঘরের অবস্থা পাকা না মাটির, নাকি বাঁশের? পরিবারের সদস্য সংখ্যা, পানীয় জলের উৎস, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, রান্নার জ্বালানি, বাড়িতে রেডিও টিভি-মোবাইল-ল্যাপটপ-ইন্টারনেট পরিষেবা, পরিবারের সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স, পরিবারের আয় ও উপার্জনকারী সদস্যের সংখ্যা— এই সবকিছুই তথ্য হিসাবে আদমসুমারিতে সংগ্রহ করার কথা।

বর্তমান ভারতের জনসংখ্যা কত ২০২২


এই তথ্যগুলো মূলত দেশের পরিকল্পনা রচনা, নীতি প্রণয়ন, ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে দেশের আগামী পরিকল্পনা গ্রহণ থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিভিন্ন গবেষণার কাজে, শিল্প-বাণিজ্যের রূপরেখা নির্ণয়ে দিশা তৈরির অন্যতম ভিত্তি হিসাবে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। যেহেতু প্রতি ১০ বছর অন্তর জনগণনা করা হয়, তাই একটি দেশ এক দশকে কতটা এগিয়েছে, বিগত দশকগুলোর তুলনায় প্রগতি ও সমৃদ্ধির গতি কতটা বেশি বা কম সবই নির্ণয় করা যায় এই পরিসংখ্যান থেকে। ভারতে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত যে জনগণনা হয়েছে তাতে সম্প্রদায় বা জাতিভিত্তিক সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে যে মাপকাঠিতে জনগণনা হয় তার ভিত্তি হল সাধারণ, তপশিলি জাতি, আদিবাসী, ধর্ম— এই শ্রেণীবিভাগকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় ১৯৯০ সালে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট তৎকালীন ভি পি সিং সরকার গ্রহণ করার পর গোটা দেশে জাতিভিত্তিক জনগণনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ২০০১ সালে দেশে জনগণনার সময় ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং সেন্সাস কমিশন কেন্দ্রের বাজপেয়ী সরকারের কাছে জাতিভিত্তিক জনগণনা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। যদিও বাজপেয়ী সরকার তাতে মত দেয়নি। বর্তমানে দেশে পুনরায় জাতিভিত্তিক বা সম্প্রদায়ভিত্তিক জনগণনার জোরালো দাবি তুলেছেন বিরোধীরা। এরই মধ্যে মহারাষ্ট্র, বিহার এবং ওড়িশাতে রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রের কাছে সম্প্রদায়ভিত্তিক কাস্ট সেন্সাসের দাবি জানিয়েছে। ২০১৫ সালে কর্ণাটক সরকার রাজ্যের নিজস্ব অর্থব্যয়ে রাজ্যে জাতিভিত্তিক জনগণনা করেছিল। কিন্তু সেই তথ্য সরকার পরিবর্তনের পর আর প্রকাশ্যে আসেনি। ওড়িশা সরকার একইভাবে কাস্ট সেন্সাসের পক্ষে মত দিলেও কোভিড অতিমারির পর তা শুরু হয়নি এখনও। বিহারে নীতীশ কুমার সরকার রাজ্যের অর্থব্যয়ে জাতভিত্তিক সেন্সাসের প্রথম পর্যায় ইতিমধ্যেই শেষ করেছে। দ্বিতীয় পর্যায় চলতি মাসে শুরু হচ্ছে। তবে এটা ঘটনা যে ১৯৩১ সালে দেশে শেষবারের মতো জাতিভিত্তিক আদমসুমারির পর গত ৯০ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে দেশে। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে, ডেমোগ্রাফি বদলে গেছে।

মানব উন্নয়ন সূচক' কী? এই সূচকের নিরিখে ভারতের স্থান কত? - NBTV


অথচ সম্প্রদায় কিংবা জাতিগতভাবে উন্নয়নের ছবিটা দেশে বর্তমানে কী অবস্থায় তা কিন্তু আদৌ স্পষ্ট নয়। আমাদের দেশে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে, ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে, ইকনোমিক সার্ভের মতো একাধিক সমীক্ষার তথ্য আছে সরকার ও জনগণের হাতে। অথচ দেশে জাতি হিসাবে নেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর তথ্য ও পরিসংখ্যান। ভারতীয় সমাজে শুরু থেকেই জাতিপ্রথা ছিল, আছে এবং আগামীতেও থাকবে। তাই দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে জাতিভিত্তিক জনগণনা যদি দেশের স্বার্থে নীতি নির্ধারণে সহায়ক হয়,তাহলে এই নিয়ে অহেতুক বিতর্ক বন্ধ করা উচিত। এই ধরনের জনগণনার ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্নে দেশের কোথায় সমস্যা রয়েছে তার যেমন একটি চিত্র পাওয়া যাবে, তেমনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোথাও বৈষম্য, কোথাও অধিক প্রাধান্য দেওয়ার ব্যবধানটাও নির্ণয় করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি এই জাতিগত সমীক্ষার ক্ষেত্রে এই সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে যাতে তথ্য যথাসম্ভব নির্ভুল হয়। কারণ ভুল বা অসত্য তথ্য প্রকাশের ফলে তা সমাজে নেতিবাচক প্রভাবও ডেকে আনতে পারে। আগামী বছর মে মাসে দেশে লোকসভার নির্বাচন। তার আগে দেশের পাঁচটি বড় রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের জোর প্রস্তুতিপর্বও চলছে। স্বাভাবিক কারণেই জাতপাতভিত্তিক রাজনীতি দেশে আবার মাথাচাড়া দেবে। আকাশ স্পর্শ করবে জাতিসুমারি বা কাস্ট সেন্সাস নিয়ে বিতর্ক। কিন্তু জাতভিত্তিক জনগণনার নামে রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি চলতে থাকলে উন্নয়নের আসল উদ্দেশ্যটাই যে ব্যর্থ হবে। এই সহজ সত্যটা রাজনীতিবিদরা জেনেও – চেপে যেতে চাইছেন। সেটাই হল পরিতাপের।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.