টেবিলের উপরে উঠে বিক্ষোভ পালটা প্রতিবাদে তপ্ত সভাকক্ষ

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অনলাইন প্রতিনিধি || ফের কলঙ্কিত হলো রাজ্য বিধানসভা। শুধু তাই নয়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চরম অসংসদীয় আচরণ, চরম অশোভনীয় এবং অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার থেকে শুরু করে বাদ যায়নি কিছুই। ত্রয়োদশ ত্রিপুরা বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিন প্রতি মুহূর্তে বিধানসভার মান – মর্যাদা, গরিমা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অশোভনীয় আচরণ ও শব্দ বাক্য ব্যবহারে। অধ্যক্ষকে কাগজের দলা ছুঁড়ে মারা, বিরোধী সদস্যদের বিধানসভার ওয়েলে থাকা টেবিলের উপর উঠে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা, টেবিল উল্টে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা, ওয়াচ অ্যাণ্ড ওয়ার্ড স্টাফদের সাথে বেনজির ধস্তাধস্তি, বারবার অধ্যক্ষের দিকে তেড়ে যাওয়া, এক ঘণ্টা ধরে ওয়েলে নেমে বিরোধীদের তুমুল বিক্ষোভ – শেগান । শুধু হাতাহাতি ছাড়া বাদ যায়নি কিছুই রাজ্য বিধানসভার ইতিহাসে সম্ভবত এমন নজিরবিহীন ঘটনা আর ঘটেনি। অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাষণ টানা এক ঘণ্টা কিছুই শোনা যায়নি, কিছুই বোঝা যায়নি। তুমুল হট্টগোল চলতে থাকে ৷ পরিস্থিতি একসময় এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যরাও পাল্টা প্রতিবাদে শামিল হন। এতে সভা আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। হাউসের ভেতর অসংসদীয় আচরণ এবং বিধানসভার মর্যাদা ও গরিমা নষ্ট করার অভিযোগ তুলে বিরোধী দলের কয়েকজন সদস্য-সদস্যাকে সাসপেণ্ড করার দাবিতে সরব হন ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যরা। শেষে একপ্রকার বাধ্য হয়ে মুখ্যমন্ত্রী দাঁড়িয়ে কংগ্রেস দলের বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মণ, সিপিএমের বিধায়ক নয়ন সরকার, তিপ্রা মথা দলের বিধায়ক বৃষকেতু দেববর্মা, বিধায়ক রঞ্জিত দেববর্মা এবং বিধায়িকা নন্দিতা রিয়াংকে শুক্রবার পুরো দিনের জন্য সাসপেণ্ড করার জন্য অধ্যক্ষের কাছে দাবি জানান। অধ্যক্ষ সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে বিরোধী দলের পাঁচ বিধায়ককে সাসপেণ্ড করেন এবং হাউস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।অধ্যক্ষের নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও ওই পাঁচ সদস্য হাউস থেকে বের না হওয়ায়। অধ্যক্ষ ওয়াচ অ্যাণ্ড ওয়ার্ড স্টাফদের নির্দেশ দেন পাঁচ বিধায়ককে হাউস থেকে বের করে দিতে। এরপরও চলতে থাকে তুমুল হট্টগোল।এরপর ওয়াচ অ্যাণ্ড ওয়ার্ড স্টাফরা হাতজোড় করে বারবার তাদের অনুরোধ করতে থাকেন বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। এর মধ্যে অধ্যক্ষ বলেন, আপনারা যদি এখন শান্তিমতো বেরিয়ে না যান, তাহলে নির্দেশটি পরবর্তী সময় বিবেচনা করবো এবং মুখ্যমন্ত্রীকেও বলবো বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য। এরপর বিরোধী সদস্যরা সকলে একজোটে ওয়াক আউট করে চলে যান বেলা বারোটা দশ মিনিটে।এরপর অর্থমন্ত্রী তার অবশিষ্ট বাজেট ভাষণ শেষ করেন।ত্রয়োদশ বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে শাসকদলের বিধায়ক যাদব লাল নাথের অশ্লীল ভিডিও দেখা কাণ্ডে শুক্রবার সভা শুরু হতেই বিরোধী দলনেতা অনিমেষ দেববর্মা বিষয়টি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পবিত্র বিধানসভায় বসে মোবাইলে অশ্লীল ভিডিও দেখছেন। এই ছবি সারা দেশের মানুষ দেখেছে। রাজ্য বিধানসভাকে কলঙ্কিত করেছেন তিনি। অথচ দুঃখের বিষয়, তার বিরুদ্ধে দল এবং সরকার, এমনকী বিধানসভা পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এটা অত্যন্ত দুঃখের এবং দুর্ভাগ্যের। এতে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তিনি যাদব লাল নাথের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তোলেন। বিরোধী দলনেতার সুরে সুর মেলান সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস বিধায়করাও। কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মণ এবং সিপিএম পরিষদীয় নেতা জিতেন্দ্র চৌধুরীও একই দাবি তোলেন। অধ্যক্ষ তখন বলেন, এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ তিনি বিরোধীদের দেবেন। এর আগে রাজ্যবাসীর স্বার্থে বাজেট ভাষণ শেষ হতে দিন। কিন্তু বিরোধীরা অধ্যক্ষের এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হননি। বিরোধীরা একজোটে দাবি জানাতে থাকেন। অপরদিকে অধ্যক্ষ সেদিকে কর্ণপাত না করে অর্থমন্ত্রীকে বাজেট ভাষণ চালিয়ে যেতে বলেন। অর্থমন্ত্রীও বাজেট ভাষণ পড়তে থাকেন। এরই মধ্যে সব বিরোধী সদস্য সদস্যরা ওয়েলে নেমে পালা করে শ্লোগান দিতে থাকেন। কখনও মথার শ্লোগানে অন্য সবাই সুর মেলাচ্ছেন। কখনও সুদীপবাবু শ্লোগান দিচ্ছেন, অন্যরা সবাই সুর মেলাচ্ছেন। আবার কখনও সিপিএমের নির্মল বিশ্বাস স্লোগান তুলছেন, অন্যরা সুর মেলাচ্ছেন।
এভাবেই প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে বিক্ষোভ। ওয়াচ অ্যাণ্ড ওয়ার্ড স্টাফরা বিরোধীদের ব্যারিকেড করে রাখেন। আধ ঘণ্টা এভাবে চলার পর সভা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। শুরু হয় কাগজের দলা পাকিয়ে অধ্যক্ষের উপর ছুঁড়ে মারা। বিরোধী সদস্যরা বারবারই অধ্যক্ষের দিকে তেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এতে ওয়াচ অ্যাণ্ড ওয়ার্ড স্টাফদের সাথে ব্যাপক ঠেলাঠেলি চলতে থাকে। এরই মধ্যে তিপ্রা মথার দুই মহিলা সদস্যা স্বপ্না দেববর্মা ও নন্দিতা রিয়াংকে সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়। তারা বার বার অধ্যক্ষের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের আটকাতে ডেকে আনা হয় মহিলা ওয়াচ অ্যাণ্ড ওয়ার্ড স্টাফদের। কিন্তু মহিলা ওয়াচ অ্যাণ্ড ওয়ার্ড কম থাকায় দুই বিধায়িকাকে সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। এরই মধ্যে বিধায়ক গোপাল রায়কে দেখা যায় ওয়েলে বড় টেবিলের একদিক তুলে নিচে ফেলছেন। এতে বড় ধরনের শব্দ হচ্ছিল। এরপর আরও কয়েকজন সদস্য মিলে টেবিলটি উল্টে ফেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওয়াচ অ্যাণ্ড ওয়ার্ড স্টাফদের জন্য তা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। আচমকা তিপ্ৰা মথার বিধায়িকা নন্দিতা রিয়াং, মথা বিধায়ক রঞ্জিত দেববর্মা, বৃষকেতু দেববর্মা ওয়েলে থাকা বড় টেবিলের উপরে উঠে অধ্যক্ষের দিকে তেড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ওয়াচ অ্যাণ্ড অয়ার্ড স্টাফরা তাদের আটকে দেন। সভায় তখন চরম উত্তেজনা। এতক্ষণ সব চুপ করে দেখার পর সরব হন ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যরা। মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী আচমকা নিজের চেয়ার থেকে উঠে বিরোধীদের দিকে তেড়ে যান। তাকে শান্ত করেন পরিষদীয় মন্ত্রী রতন লাল নাথ। শুরু হয় দুই পক্ষের তুমুল বাকবিতণ্ডা। দুই পক্ষের মধ্যে ব্যারিকেড হয়ে থাকেন ওয়াচ অ্যাণ্ড ওয়ার্ড স্টাফরা। এভাবে চলতে থাকে আরও বেশ কিছুক্ষণ। কয়েকজন বিরোধী সদস্যকে সাসপেণ্ড করার দাবিতে সোচ্চার হন ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যরা। মুখ্য সচেতক কল্যাণী রায় বিরোধীদের আচরণে তীব্র নিন্দা জানিয়ে অধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সবর হন পরিষদীয় মন্ত্রী রতনলাল নাথ সহ ট্রেজারি বেঞ্চের সকল সদস্য-সদস্যারা। এরপর সভা নিয়ন্ত্রণে আনতে অধ্যক্ষ বিরোধী দলের পাঁচ সদস্যকে এ দিনের জন্য সাসপেণ্ড করেন।এরপর দ্বিতীয় বেলা সভা শুরু হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী দাঁড়িয়ে বলেন, আমরা গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করি। বিধানসভা হলো গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ পীঠস্থান। আমরা চাই না কোনও কারণে গণতন্ত্রের গরিমা এবং বিধানসভার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হোক । তাই আমি প্রস্তাব রাখছি যাদের সাসপেণ্ড করা হয়েছে, সেই নির্দেশ ফিরিয়ে নেওয়া হোক। মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রস্তাবে অধ্যক্ষ সাসপেণ্ডের নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেন। অধ্যক্ষ নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর একে একে পাঁচ বিধায়কই সভায় হাজির হন। কিন্তু দ্বিতীয় বেলা সভা শুরু হওয়ার পর ফের বিরোধী দলনেতা অনিমেষ দেববর্মা যাদব লাল নাথ ইস্যু তুলে, তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে তাকে সিম্বোলিক সাসপেণ্ড করার দাবি জানান। যদি তা না করা হয় তাহলে জনগণ কী ভাববে? এরপর বিরোধী নেতা বলেন, তাও যদি না হয়, তাহলে অন্তত একটা নিন্দা প্রস্তাব বিধানসভায় আনা হোক।এরপর সংসদীয় মন্ত্রী রতনলাল নাথ আইন উল্লেখ করে বিরোধীদের বোঝনোর চেষ্টা করেন, কেন যাদব লাল নাথের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এই ইস্যুতে বিধানসভা স্থগিত হতে পারে না। (বিরোধীরা বিধানসভা স্থগিত করার প্রস্তাব এলেছিলেন।) যাদব লাল নাথের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেই অভিযোগের সাপোর্টিং কোনও তথ্য প্রমাণ নেই। সিপিএম বিধায়ক জিতেন্দ্র চৌধুরী বলেন, শাসকদল বিষয়টি লঘু করার চেষ্টা করছে। পরপর তিনদিন তিনি বিধানসভায় বসে অশ্লীল ভিডিও দেখেছেন। সারা দেশ দেখেছে। অথচ দলের এবং অধ্যক্ষের একটি শব্দও নেই। ব্যবস্থা না নিলে ভুল বার্তা যাবে। জনগণ ভাববে বিধানসভায় বসে বিধায়করা এসবই করেন। এই ঘটনা দুঃখের এবং অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের।বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মণ বলেন, যাদবলাল নাথ নিজে স্বীকার করেছেন। অথচ মুখ্যমন্ত্রী চুপটি মেরে বসে থাকবেন, এটা তো হতে পারে না। পুরো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। অধ্যক্ষ বলেন, ভিডিও যাচাই হয়নি। আগে ভিডিও যাচাই হোক। একতরফা বিচার হয় না। এরপর আবার সভা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দুই পক্ষে তুমুল হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। একই ইস্যুতে ফের বিরোধীরা বেলা। দুটো পঞ্চাশ মিনিটে একযোগে ওয়াক আউট করেন। তখন বিধায়ক গোপাল রায় এবং মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী তুমুল বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে যান। শেষে গোপালবাবুও বেরিয়ে যান। এরপর সভার কাজ চলতে থাকে। বিরোধী সদস্যরা পুনরায় সভায় এলেও আর যাদবলাল নাথ ইস্যু নিয়ে কেউ কিছু বলেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে একটি জনস্বার্থ বিষয়ক প্রস্তাবের উপর আলোচনাকালে ফের রাজ্য বিধানসভায় ঘটে যায় নজিরবিহীন ঘটনা। সেই ঘটনায় কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মণকে বিধানসভায় অভব্য আচরণ ও অশোভনীয় শব্দ বাক্য ব্যবহারের জন্য বাজেট অধিবেশনের পুরো সেশন থেকেই তাকে সাসপেণ্ড করা হয়।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

নিগো – অন্ধ প্রশাসন!!

নিগো বাণিজ্যের রমরমা চালানোর জন্যই কি ১৮ সালে রাজ্যের মানুষ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো?রাজ্যের আকাশ…

18 hours ago

বিমানযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে পুলিশের তদন্ত শুরু!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-এয়ারইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের কর্মীর চরম গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণে রীতা বণিক (৫৯) বিমান যাত্রীর…

18 hours ago

হরিয়ানাঃ পাল্লা কার পক্ষে?

হরিয়ানা কি বিজেপির হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে?শাসক বিজেপির হাবভাব দেখে তেমনটাই অনুমান করছে রাজনৈতিক মহল।প্রধানমন্ত্রী…

2 days ago

রাজধানীতে চাঁদার জুলুমে অতিষ্ঠ মানুষ!!

অনলাইন প্রতিনিধি:-মুখ্যমন্ত্রীডা. মানিক সাহার নির্বাচনি এলাকার আপনজন ক্লাবের চাঁদার নামে বড় অঙ্কের তোলাবাজির অভিযোগের রেশ…

3 days ago

ইন্ডিয়ান বুকে রাজ্যের মেয়ে ঝুমা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ইচ্ছে ছিলো অনেক আগে থেকেই। অবশেষে নিজের ইচ্ছেকেই বাস্তবে পরিনত করলো ঝুমা দেবনাথ।…

3 days ago

সুশাসনে আইনশৃঙ্খলা!

রাজ্যে কি সত্যিই আইনের শাসন রয়েছে?সাধারণ মানুষ কিন্তু প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।সরকার বলছে রাজ্যে সুশাসন…

3 days ago