ড্রাগনের নি:শ্বাস
দিল্লীর প্রগতি ময়দানে মণ্ডপমের মহামঞ্চে জি ২০ সেই সম্মেলনের পূর্বাহ্ণে ‘স্ট্যান্ডার্ড ম্যাপ-২০২৩’ শীর্ষক মানচিত্র প্রকাশ করে অরুণাচলকে তাদের অংশ বলে ফের দাবি করেছে চিন। মানচিত্র প্রকাশ করে বেজিং দাবি করেছে, অরুণাচলের পাশাপাশি লাদাখের লেহ জেলার অন্তর্গত আকসাই চিন তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চিন সাগরও তাদের অংশ। মানচিত্রটি প্রকাশ্যে এনেছে চিনের সরকারী সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’ এমনকী, কয়েকটি উপগ্রহ-চিত্র প্রকাশ করে কিছু সংবাদমাধ্যমও দাবি করেছে, আকসাই চিনে বাঙ্কার তৈরি করে ফেলেছে চিন। বেজিং অবশ্য বরাবরই অরুণাচলকে দক্ষিণ তিবুত বলে দাবি করে। দাবি করে, ১৯৬২ সালের যুদ্ধে আকসাই চিন তারা দখল করেছিল। যদিও সেই দাবি বরাবর অস্বীকার করে এসেছে ভারত চিনের এই মানচিত্র প্রকাশ্যে আসার পর বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর চিনের এমন দাবিকে পত্রপাঠ নাকচ করে বলেছেন, ‘যে ভূখণ্ড তাদের নয়, সেগুলিকে নিজেদের মানচিত্র বলে দেখানো চিনের পুরনো অভ্যাস। ভারতের অংশ নিজেদের মানচিত্রে বসিয়ে নিলে কিছু বদলায় না। আজগুবি দাবি করলেই অন্যের ভূখণ্ড নিজেদের হয়ে যায় না।’ তবে এটাও ঠিক যে চিনের ‘আজগুবি’ দাবিকে নস্যাৎ করলেও বেজিংকে পাল্টা চাপে রাখার কোনও বিবৃতি জারি করেনি বিদেশমন্ত্রক।
ভারতকে উত্তেজিত করার জন্য ড্রাগনের এই নি:শ্বাস নতুন নয়। তাৎপর্যের বিষয়টি হল ‘টাইমিং’। জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনে দিল্লী আসার ঠিক প্রাককালে, অধিকন্তু সদ্যসমাপ্ত জোহানেসবার্গের ব্রিকস সম্মেলনে লাদাখ সমস্যা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পার্শ্ববৈঠকের স্মৃতি টাটকা থাকতেই কেন এমন মানচিত্র প্রকাশ করে নয়াদিল্লীকে উত্ত্যক্ত করতে চাইলেন জিনপিং? ভারতের মাটি নিয়ে এমন ধৃষ্টতা চিনের কোন ঔদ্ধত্যের বহি:প্রকাশ ? তবে কি মণ্ডপমের মঞ্চে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একাসনে বসার আগেই জিনপিং এই মর্মে আগাম বার্তা দিয়ে রাখলেন যে, পূর্ব লাদাখের একটা বড় অংশে লালফৌজের টহলদারিতে কোনও পরিবর্তন হবে না ? গালওয়ান সংঘর্ষের পরেও পূর্ব লাদাখ নিয়ে তাদের অবস্থান যে যথা পূর্বং, অনেকদিন ধরেই ভারতকে সেই সঙ্কেত দিয়ে চলেছে চিন। কিন্তু পক্ষান্তরে আশ্চর্যেরও বটে, প্রধানমন্ত্রী মোদি অথবা তার দল বিজেপি কিংবা তাদের মাতৃসংগঠন আরএসএস বা তাদের সাধুসন্তদের শাখা সংগঠন বিশ্বহিন্দু পরিষদ কখনও পাল্টা বলেনি যে, পূর্ব লাদাখে চিনকে মে-২০২০ পূর্ববর্তী ‘স্টেটাস কুয়ো’ বা স্থিতাবস্থা বহাল রাখতে হবে। বরং লক্ষণীয় শাসকদলের যে নেতারা গালওয়ান কাণ্ডের পরে দাবি করতেন যে চিন ভারতের সূচ্যগ্র জমিও দখল করেনি, এখন তারাই বলছেন ভারতের চাপে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে লালফৌজ পিছু হঠে সম্মত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্যের মাঝেও তিন বছর ধরে চিনের কাটা ভারতের গলায় আটকে আছে। সেই কাঁটা হল, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার একাধিক বিন্দুতে ড্রাগনের দেশের আগ্রাসন। দুই দেশের সীমান্ত জট কাটাতে সামরিক স্তরের লাগাতার ১৮টি বৈঠক হয়েছিল এই পর্যায়ে। সম্প্রতি ব্রিকসের ঊনবিংশতিতম সংস্করণটি চলে টানা দুই দিন। বৈঠকশেষে যৌথ বিবৃতিতে যত দ্রুত সম্ভব ভারত-চিন সীমান্ত সংকট মেটানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা এর আগে কখনও হয়নি। জিনপিংয়ের সঙ্গে দোলনায় দুলেছিলেন। মোদি, মামল্লপুরমের ইতিহাস এবং উহান ঝিলের নিসর্গ ভাগ করে নিয়েছিলেন। ২০১৪ থেকে ২০২০-র জুনের গালওয়ান সংঘর্ষ পর্যন্ত জিনপিংয়ের সঙ্গে দুইবার ঘরোয়া বৈঠকের পাশাপাশি আরও আঠারোবার সীমবৈঠক করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর ইয়াংজি এবং গঙ্গা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে। ব্রিকসে মোদি- জিনপিংয়ের পার্শ্ববৈঠকের আগে দুই দেশের সেনার মেজর জেনারেল পদমর্যাদার অফিসারদের মধ্যে ছয়দিন ধরে বৈঠক হয়েছিল। বোঝা যাচ্ছে, এত কিছুর পরেও চিনের আগ্রাসী মেজাজ না যযৌ ন তস্থৌ । প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, ভূকৌশলগত ভাষা বদলাচ্ছে। গোটা বিশ্ব সংকটমোচনের জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ‘এক বিশ্ব এক পরিবার এক ভবিষ্যৎ’র স্লোগান পাথেয় করে তিনি ভি ২০ মহাযজ্ঞের সমিধ প্রস্তুত করছেন। বসুধৈব কুটুম্বকমের রঙ্গোলি সাজাচ্ছেন। এখন শি জিনপিং কী মুখ নিয়ে দিল্লীর আতিথেয়ত গ্রহণ করবেন!