তলানিতে সম্পর্ক
ভারত ও কানাডার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কখনোই বৈরিতার ছিল না। বরং এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের।উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা, আর এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম দেশ ভারত। কানাডার মোট জনসংখ্যা প্রায় চার কোটিরও কম।অথচ কানাডায় অভিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ যারা বসবাস করেন, তাদের অন্যতম অংশই হলেন ভারতীয়।অর্থাৎ কানাডায় বসবাসকারী মোট ভারতীয়ের সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ।এর মধ্যে ৭ লক্ষ ৭০ হাজার হলেন শিখ ধর্মাবলম্বী।পাঞ্জাবের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখ বসবাস করেন এই কানাডাতেই। কারণটা হল কানাডার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বুনোট মূলত শিক্ষা,সংস্কৃতি, কর্মসংস্থান ও বাণিজ্যকে ঘিরে দিন দিন দানা বেঁধেছে। ভারত থেকে যারা কানাডায় যান তাদের মূল নজরই থাকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ।উচ্চশিক্ষার পর চাকরি সূত্রে অধিকাংশ ভারতীয় কানাডাতে গিয়েছেন।কানাডাতে পড়তে যাওয়া মোট বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের ৪০ শতাংশই হলো ভারতীয়।বিগত ৫ বছর ধরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে কানাডা যাওয়ার ঝোঁক ভারতীয়দের মধ্যে আরও বেড়েছে। বর্তমানে কানাডাতে পড়ুয়া মোট ভারতীয় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সোয়া তিন লক্ষ, আর উচ্চশিক্ষায় মেধাবী ভারতীয়দের যথেষ্ট কদর আছে কানাডাতে।কানাডার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কও বেশ মজবুত।ভারত যদি কানাডা থেকে সার, কয়লা, কোক আমদানি করে তাহলে কানাডাতে পাঠানো হয় ইলেকট্রনিক সামগ্রী, বিমানের যন্ত্রপাতি এবং আরও নানাবিধ উপকরণ। ভারত পৃথিবীর যে সব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক দৃঢ়তার সঙ্গে উন্নত করেছে সেই তালিকায় কানাডার স্থান বেশ ওপরে। প্রায় ১০ নম্বরের কাছাকাছি। এই রকমই দ্বিপাক্ষিক মধুর সম্পর্কের মধ্যে সম্প্রতি ভারত – কানাডা সম্পর্কের তাৎপর্যপূর্ণ অবনতি ঘটে গেছে।খালিস্তানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কানাডার মাটিকে ভারতবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করছে বলে অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছিল নয়াদিল্লী। সম্প্রতি শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে বড়সড় চিড় ধরেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো, সম্প্রতি নিজ্জরের হত্যার পেছনে ভারতের হাত আছে সে ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তার হাতে আছে বলে দাবি করেছেন। ভারত এই দাবি খারিজ করেছে। তারপরই ক্ষোভ এবং তার পাল্টা হিসাবে দুতাবাসের দুই কর্মী বহিষ্কার করেছে দুই দেশ। থেমে গেছে ভারত – কানাডা বাণিজ্য আলোচনা বৈঠক। কানাডায় ভ্রমণের উপর ভারত সতর্কতা জারি করেছে এবং কানাডার নাগরিকদের ভারতীয় ভিসা দেওয়া সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। ইন্দো-কানাডা সম্পর্কের এই আকস্মিক অবনতি এবং কূটনৈতিক বহিষ্কার কোনওভাবেই ভালো পদক্ষেপ নয়।ভারত – কানাডার মধ্যে সম্পর্কের রসায়ন মধুর হলেও উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতাও বারবার সামনে এসেছে বিভিন্ন সময়ে। তবে এই পর্বে কূটনৈতিক বহিষ্কারের মতো কঠোর পদক্ষেপ ইতিপূর্বে হয়নি। খালিস্তানি ইস্যু নিয়ে ভারত – কানাডার সম্পর্কের তিক্ততা একটু একটু করে বাড়ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। পাঞ্জাবকে পৃথক স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিতে কানাডায় বসবাসকারী একাংশ বিচ্ছিন্নতাবাদী দীর্ঘদিন ধরেই সন্ত্রাসী কাজ চালাচ্ছে। ১৯৮৫ সালে কানাডায় এয়ার ইণ্ডিয়ার কনিষ্ক বিমানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, ৩৯১ জন যাত্রী নিহত হওয়া এবং ইতোপূর্বে শিখদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরকে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহিংসতা এই সবকিছুর সঙ্গেই খালিস্তানপন্থীরা জড়িয়ে যায়। স্বর্ণমন্দিরে সেনা প্রবেশ, অপারেশন ব্লু স্টার, পরবর্তী সময়ে দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়া – – এই সবই ছিল একই সুতোয় বাঁধা। সম্প্রতি জি টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে এসে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকও করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সম্পর্কের শীতলতা তখন প্রকট হতে শুরু করে। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় খালিস্তান দাবির পক্ষের লোকজন ভারতীয় দূতাবাসেও হামলার চেষ্টা চালায়।
খালিস্তানপন্থীদের এসব তৎপরতায় কানাডা সরকারকে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানায় ভারত। কিন্তু কানাডা পররাষ্ট্রমন্ত্রক জানায়, কানাডার সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচির অধিকার স্বীকৃত। তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল, গত ২০২০ সালে দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলনে সরকার বিরোধী যে বছরভর কর্মসূচি পালিত হয়েছে তাতে শিখ ও জাঠ সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল নজরকাড়া। এর পেছনে জাস্টিন ট্রুডোর সমর্থনের বার্তাও ছিল প্রকাশ্যে। স্বাভাবিক কারণেই সমালোচকরা এই আন্দোলনে কানাডাবাসী খালিস্তানিদের মদত দেখতে পেয়েছেন। সব মিলিয়ে সম্পর্কের চিড় এরপর আরো চওড়া হতে থাকে। যদিও তা প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু সমস্ত শিষ্টাচার এবং কূটনৈতিক রীতি ভেঙে কানাডার প্রধানমন্ত্রী যে কৌশলে কানাডায় খালিস্তানি নেতার হত্যার পেছনে ভারত সরকারকে দায়ী করলেন – তা রীতিমতো বিরল এবং নিঃসন্দেহে দু’দেশের বিশ্বাস ও আস্থার জায়গায় এটা যে বড়সড় ধাক্কা তা বলার মতো অবকাশ রাখে না। ভারত – কানাডার এই কুটনৈতিক টানাপোড়েন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কতটা ছায়া ফেলে সেটাই এখন দেখার।