তাৎপর্যের সন্ধিক্ষণে!!

 তাৎপর্যের সন্ধিক্ষণে!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি এ যাবৎ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অভ্যস্ত ছিলেন,শরিক-নির্ভর সরকার চালানোর দায় নরেন্দ্র মোদির এই প্রথম।এই অভিজ্ঞতাকে আপন অহমিকার কারণে বিড়ম্বনা মনে না করে তিনি এবং তার সতীর্থরা একে যথার্থ গণতন্ত্র অনুশীলনের সুযোগ হিসাবে দেখলে আখেরে ভারতীয় গণতন্ত্রেরই
লাভ।
নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগে ভাবা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের হ্যাটট্রিক উদ্যাপন করা হবে জনতার দরবারে।সে কারণে তারই আমলে নতুনভাবে তৈরি ‘কর্তব্য পথে’ শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান করার প্রস্তাবও বিবেচিত হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদি ছুঁতে আগ্রহী ছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড।নেহরু ১৯৫২, ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালের নির্বাচন জিতে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের প্রতিটি জয়ই ছিল নিরঙ্কুশ। কারও সহায়তা ছাড়াই তিনি সরকার গড়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রিত্বে মোদির হ্যাটট্রিক হলেও সে অর্থে নেহরুর রেকর্ড অক্ষুণ্ণই রইলো। হ্যাটট্রিক পর্বে এখন তাকে জোট শরিকদের সাহায্য নিয়ে,তাদের নানাবিধ বায়নাক্কা সামলে সরকার চালাতে হবে।নেহরুর রেকর্ড ভাঙা ছাড়াও মোদির আরও একটি অভিলাষ ছিল ১৯৮৪ সালের ভোটে রাজীব গান্ধীর জেতা ৪১৩ আসন টপকে নতুন রেকর্ড গড়া।সম্ভবত ‘চারশো পার’ স্লোগান তৈরি হয়েছিল সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই।দিনের শেষে মোদির দুই ইচ্ছাই অপূর্ণ থেকে গেলো।তা যাক, এই জনাদেশকে গুরুত্ব দিয়ে, জোট সরকারকে যথার্থ মর্যাদা দান করে, দেশের নাগরিকদের প্রতি যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করে তিনি সরকার পরিচালনা করবেন, দেশবাসীর প্রত্যাশা সেটাই।
এক্ষণে নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, এই নির্বাচনি ফলাফলের মধ্যে কোনও সরল একমাত্রিক কার্যকারণসূত্র নেই, বরং এর মধ্যে নিহিত আছে এক বিচিত্র এবং জটিল রাজনৈতিক বাস্তবের সমাহার।একদিকে ওড়িশা বা অন্ধ্রপ্রদেশে বিজেপি ও শরিক তেলেগু দেশম পার্টির সাফল্য, অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশের হৃদয়পুরে বিপর্যয়, পশ্চিমবঙ্গে অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটাতে গিয়ে পুনর্মুষিক ভব। ক্ষমতার অধীশ্বরদের বুঝতে হবে, এই ফল একদিকে যেমন সামগ্রিকভাবে ভোটের অনুপাতে ২০১৯-এর থেকেও উত্তম, অন্যদিকে প্রায় ষাটটি আসন খুইয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো, এই বহুমুখী ফল স্পষ্টতই ভারতীয় রাজনীতির বহুমুখী বিচিত্রতার পরিচায়ক।এর পাশাপাশি কংগ্রেসের পুনরুজ্জীবন, দশ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর লোকসভায় বিরোধী নেতার অস্তিত্ব,সেটিও আখেরে গণতন্ত্রেরই সুলক্ষণ।আবার, মহারাষ্ট্র বা উত্তরপ্রদেশের ফলাফল সঙ্কেত দিয়েছে, সর্বভারতীয় দলকে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে কার্যকর ও বাস্তব সচেতন সমন্বয়ের পথে যেতে হবে, তবেই সাফল্য মিলবে। তেমনই, ‘ইন্ডিয়া’ নামক মঞ্চটিকে, তার বহু সমস্যা এবং ঘাটতি সত্ত্বেও ব্যর্থ বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। কারণ, এই মঞ্চের শরিক বা সংশ্লিষ্ট দলগুলি অবশিষ্ট বিরোধী দলের তুলনায় অনেক ভালো ফল করেছে। অত:পর সংসদে এবং সংসদের বাইরে তাদের বর্ধিত শক্তি ও নতুন উৎসাহের বাস্তবকে কাজে লাগিয়ে ইন্ডিয়া-র শরিকরা একটি কুশলী বিরোধী শিবিরের ভূমিকা পালন করতে পারবে কি না, ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সেই প্রশ্নটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।এই নির্বাচন কেবল শাসক নয়, বিরোধীদেরও একটি শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে।আত্মশুদ্ধির সুযোগ। বহুস্বর এবং বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের জোরদার অনুশীলনের পথে ফিরে আসার সুযোগ।বস্তুত, ভোটাররাই যুগপৎ সরকার এবং বিরোধী পক্ষকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন।তারাই ভোটাধিকারের মাধ্যমে প্রত্যয়ী সুবিবেচনার স্পষ্ট প্রমাণ দিয়ে রাজনীতিকে সেই পথে ফিরিয়ে এনেছেন।তবে নাগরিকদেরও মাথায় রাখতে হবে যে, কেবল ভোটের দিনে ভোট দিয়ে এলেই তাদের কর্মযোগ সম্পন্ন হয় না। গণতন্ত্র তখনই সার্থকনামা হতে পারে, যদি তারা প্রত্যেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাস্থ্যরক্ষায় যত্নবান হন। ক্ষমতাবানেরা সেই ব্যবস্থাকে নিজেদের কবজায় এনে যথেচ্ছাচারে তৎপর হলে নাগরিকের দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়।এখানেই নাগরিক প্রজা থেকে স্বতন্ত্র।দুনিয়া জুড়েই এখন গণতন্ত্রের বিরোধী শক্তিগুলির দাপট বাড়ছে।আমরা তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের সাধনায় ফিরতে পারব কি না, তার উত্তর আছে ভবিষ্যতের পেটিকায়।কিন্তু ভবিষ্যৎ কখনও পূর্বনির্ধারিত হয় না, নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগে তাকে গড়তে হয়। অতএব, সার্বিক এই প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যের এক সন্ধিক্ষণে উপনীত ভারতবর্ষ। সরকার,বিরোধী এবং নাগরিকরা সেই তাৎপর্যকে অনুধাবন করবেন এটাই বিধেয়।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.