এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা মিশর। স্বচ্ছতোয়া
নীলনদের আশীর্বাদে মিশরবাসী ধন্য। সোনালি স্নেহ ছড়িয়ে থাকে সর্বত্র। নদীর আশীর্বাদে খেতগুলিতে ফসল উপছে পড়ে। কিছুমানুষ চাষবাস করে, কেউ বা কাজ করে খনিগুলিতে আর কিছুমানুষ রচনা করে চলে
পিরামিড। অজস্র মিশরীয় শ্রমিকের
ঘাম-রক্ত-শ্রম আধিভৌতিক বিশ্বাস বিত্তবানের প্রতি ভয় ও উত্তুঙ্গ স্বপ্ন দিয়ে গড়া হয়ে চলে এক একটি পিরামিড।
ভূমধ্যসাগরের আটশো কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত থেবিস বর্তমানে মিশরের রাজধানী। এখানেই বাস করেন ফারাও আমেনহোটেপ
ও মহারানি নেফারতিতি। আজকের দিনটি মিশরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন আজ থেকে ফারাওয়ের আদেশে মিশরে লাগু হতে চলেছে এক নতুন নিয়ম। আজ থেকে মিশরে একমাত্র সূর্যদেব অটেনের পূজা ছাড়া আর কোনও দেবতার পূজা করা যাবে না। তাই মিশরের মানুষ ভীষণ চিন্তিত। আবহমান কাল ধরে নন, আমুন, রা, মত, তা, আইসিস ইত্যাদি শত শত দেবতার পূজা করে অভ্যস্ত মিশরের মানুষ আজ ভাবছে যে, নিরাপদ থাকবে তো মিশর ? দেবতার অভিশাপে বিপর্যয় নেমে আসবে না তো মিশরের ওপর? ফারাও আজ আরও একটি নতুন পদক্ষেপ নেবেন। পুরোনো রাজধানী ছেড়ে ফারাও তার নতুন রাজধানীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। সূর্যদেব
অটেনের নাম অনুসারে ফারাও নিজের নতুন নাম নেবেন আখেনাতন ও নতুন রাজধানীর নাম রাখবেন আখেতাতেন। ফারাও এগিয়ে চলেছেন শোভাযাত্রা করে। থেবিসবাসী পথের দু’ধারে দাঁড়িয়ে ফারাওকে শেষবারের মতো অভিবাদন জানাচ্ছে। রাজদর্শন সচরাচর হয়
না। তবু থেবিসবাসী আজ একাধারে কিছুটা বিমর্ষ ও উল্লসিত। এখন থেকে ফারাওয়ের নতুন রাজধানী শহর গুরুত্ব পাবে আর থেবিস হারিয়ে যাবে অনুজ্জ্বলতায়। ফারাও চলেছেন। অলৌকিক এক ঘটনার মতো সাধারণ মানুষ দেখছে এই শোভাযাত্রা। রত্নখচিত শকটগুলি পরপর চলেছে। প্রথমে ফারাও, তারপর মহারানি নেফারতিতি, ফারাওয়ের ভগিনী রানি, রাজপুত্র তুতেনখামেন ও রাজকন্যারা পরপর চলেছেন। রাজপুত্র তুতেনখামেনের মা সম্পর্কে ফারাওয়ের ভগিনী হন। মহারানি
নেফারতিতির কোনও পুত্র নেই। ছয় রাজকন্যার জননী নেফারতিতি।রাজপরিবারের সকলেই মাথায় মনুষ্য কেশ দিয়ে নির্মিত পরচুলা পরেছেন। নারীরা প্রত্যেকেই পরিধান করেছেন কালাসিরি। এই রত্নখচিত বস্ত্রখণ্ড বুকের দুইপাশ দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছেন নারীরা। একমাত্র মহারানি
নেফারতিতি ছাড়া আর সকলেই বক্ষবাস পরেছেন। মহারানির বক্ষ উন্মুক্ত। মহারানির দীর্ঘ গ্রীবা ও ক্ষুদ্র স্তন মিশরীয় সৌন্দর্যের চরম প্রকাশ বলে মিশরবাসী মনে করে।
ফারাও উন্মুক্ত ঊর্ধ্বাঙ্গে জড়িয়েছেন পশুচর্ম। নিম্নাঙ্গে সূক্ষ্মতম মলমলের শ্বেত বস্ত্র। আজ উপাসনার দিন বলে সকলেই শ্বেত বস্ত্র পরিধান করেছেন। শ্বেত বস্ত্রে নিজেদেরকে
সাজিয়েছে আপামর মিশরবাসীও। সমবেত জনতার মধ্যে দাঁড়িয়েছিল দু’টি মেয়ে। একজনের নাম আনু অন্যজন নেদজেম। এই
আড়ম্বর ও বিলাসিতা দেখে তারা মুগ্ধ ও বিস্মিত। আনু বলল, ‘আমি আর ঘরে
ফিরব না রে।’ ‘কেন?’ নেদজেম অবাক হয়ে
বলল। আনু হেসে বলল, ‘গরিবের ঘরে
গরিবের মতো বাঁচা অনেক হল। এখন থেকে একটু অন্যভাবে বাঁচব।’ ‘তার মানে কীভাবে বাঁচবি তুই?’ আনু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল,
‘আমি তোদের মতোন সাধারণ নই। আমি অনেক রূপ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি। আমি কোনও কষ্টের জীবন কাটাব না। আমি আজ ফারাওয়ের এই শোভাযাত্রার পিছুপিছু যাব।
কারও না কারও চোখে আমি পড়বই। আর তারপর আমার নিজের ভাগ্য আমি নিজে দেখে নেব।’ নেদজেম অবাক হয়ে দেখে তার
বাল্যসঙ্গিনীকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, ‘আমি কিন্তু পিরামিড তৈরির কাজই করব। পবিত্র মমির সঙ্গে পিরামিডের গহ্বরে দেওয়ার জন্য পুতুল বানাব। পিরামিডের ভিতরে কারুকাজ করব। অল্প রোজগার করব কিন্তু থেবিস ছেড়ে কোথাও যাব না।’
আনু এই কথা শুনে একদলা থুতুফেলল। তারপর দৌড়ে পালাল। যেতে যেতে বলে গেল, ‘থাক তুই এখানে। না খেয়ে মর তাহলে। আমি চললাম আমার ভাগ্যের সন্ধানে।’ আনু চলে গেল আর নেদজেম ফিরে গেল তার জীর্ণ কুটিরে। নতুন রাজধানীতে পৌঁছে ফারাও ও মহারানি চূড়ান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নগরের ঠিক মাঝখানটিতে তৈরি করা হয়েছে মহারানি নেফারতিতির স্বপ্নের বিলাসবহুল প্রাসাদ। অপূর্ব সুন্দর এই প্রাসাদে বিলাসিতার অজস্র উপকরণের পাশাপাশি নেফারতিতি
আর একটি জিনিস পেয়েছেন। সে হল মেরাইব। মহারানির ব্যক্তিগত সহায়ক। রূপ, গুণ, কলাকৌশলে পুরুষশ্রেষ্ঠ সে। মহারানি তার পৌরুষে মুগ্ধ। ফারাওয়ের সাহচর্য পান না বলে এখন আর বিশেষ দুঃখে থাকেন না মহারানি মেরাইবকেইদিয়েছেন অন্তঃপুর
সামলানোর সমস্ত দায়িত্ব। ফারাও সঅন্তঃপুরিকাকে থেবিস থেকে এখানে এই নতুন রাজধানীতে আনতে পারেননি। ফারাওয়ের অন্তঃপুর তাই শূন্য। নেফারতিতি মেরাইবের উপরেই দায়িত্ব দিয়েছেন এই শূন্য অন্তঃপুর ভরিয়ে তোলার। অজস্র সুন্দরী নারী শোভিত রাজ অন্তঃপুর ফারাওয়ের মর্যাদা বহন করে। তবে মেরাইব তার কথা রেখেছে। প্রতিদিনই নিত্য নব সুন্দরীতে ভরে উঠছে প্রাসাদ। নেফারতিতির যে কোনও আকাঙ্ক্ষা পূরণে মেরাইব সদা প্রস্তুত। আমারনা শহরের এক সাধারণ যুবক মেরাইবও কি কখনও ভেবেছিল যে জগৎবিখ্যাত সুন্দরী
নেফারতিতির সান্নিধ্য সে পাবে! এই নতুন রাজধানীতে ফারাও এক বিশাল উৎসবের আয়োজন করলেন। প্রজাসাধারণের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য এই উৎসব। বস্তুত এক দেবতা পূজার নির্দেশ জারি হওয়ার জন্য
প্রজাদের মধ্যে যে ক্ষোভ জেগে উঠেছে সেই ক্ষোভ প্রশমনের জন্যই এই উৎসব। উৎসবের দিন সন্ধ্যায় রত্নসিংহাসনে সিংহচর্মমাত্র পরিধান করে ফারাও এসে বসলেন। পাশেই বসলেন নেফারতিতি। অঙ্গে রত্নালঙ্কার ছাড়া অপর কোনও বস্ত্র নেই। ফারাও ও মহারানি উভয়েরই ওষ্ঠ ও চক্ষু দু’টি অপূর্ব বর্ণে রঞ্জিত। মহারানির অনাবৃত শরীরে দীর্ঘ গ্রীবাটি যেন মরালীর সৌন্দর্যকে মনে করিয়ে দেয়। গরবিনি নেফারতিতি যুগান্তরের প্রান্তরে অনন্ত রূপসৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রজারা সেদিন অজস্র উপহার আনল তাদের সম্রাটের জন্য। ফারাও বিতরণ করলেন সুখাদ্য, অর্থ ও মিশরের সুবিখ্যাত মলমল বস্ত্র। তবে ফারাওয়ের জন্য সেরা উপহারটি বহন করে আনল উত্তরের বণিকেরা। তারা এক অপূর্ব সুন্দরী নারী নিয়ে
এসেছে ফারাওয়ের জন্য। ফারাও গ্রহণ করলেন এই মহার্ঘ উপহার। নারী ফারাওয়ের সম্মুখের ভূমি স্পর্শ করে চুম্বন করল। ফারাও তার বাম চরণ দিয়ে স্পর্শ করলেন নারীর উন্মুক্ত স্তন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কী নারী?’ নারী মাথা নীচু করে উত্তর দিল
‘আনু।’ সমস্ত রাত্রি ধরে উৎসব চলতে লাগল। মধ্যরাত্রিতে ফারাও ও মহারানি সভা ত্যাগ
করলেন। এবার কোনও রাজকন্যাকে এই সভা পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে।
রাজকুমারীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল। চতুর্থ কন্যাটিকে পছন্দ করলেন পিতা। প্রজারা জয়ধ্বনি দিতে লাগল। অজস্র দাসদাসী শোভাযাত্রা করে ফারাও ও মহারানিকে
শয়নকক্ষে নিয়ে গেল। আজ ওরা একসঙ্গে শয়ন করবেন। শয়ন করার পূর্বেফারাও একবার কন্যাটির কথা ভাবলেন। অপরূপা সে। সবক’টি কন্যার মধ্যে সে শ্রেষ্ঠা। কিন্তু কার অঙ্কশায়িনী হবে এই নারী ? এ যে দেবভোগ্যা! আনুর স্বপ্নপূরণ হয়েছে। ফারাওয়ের কৃপা পেয়েছে সে। মেরাইবের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার। মহারানি নেফারতিতিও তাকে অগাধ বিশ্বাস করেন। আর কী চাই তার জীবনে? এই সব কি সে কখনও ভাবতে পেরেছিল? তবু মানুষের
আকাঙ্ক্ষা অপূরণীয়। রাজপরিবারের
বিলাসিতার সামগ্রীগুলি যখনই সে হাত দিয়ে স্পর্শ করে তখনই তীব্র লোভের শিকার হয় সে। এই সব দ্রব্য তারও তো হতে পারত! বর্তমানে রানি নেফারতিতির বেশ পরিবর্তনের
সময় সাহায্যকারিণীর কাজ করে সে। মহার্ঘ অলঙ্কার ও রঞ্জনীগুলি এক-এক করে এগিয়ে দেয় সে, আর অভিজ্ঞ শিল্পী ধীরে ধীরে সাজিয়ে তোলেন জগৎ সেরা সুন্দরীটিকে।
সম্পূর্ণরূপে সজ্জিত হয়ে মহারানি যখন অধরকোণে হাসেন বা কটাক্ষ করেন তখন ফারাও তো কোন ছার সূর্যদেব অটেনও বোধহয় মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। মহারানির সাজসজ্জা হয়ে গেলে মহারানি চলে যান কিন্তু আনু যায় না। হাত বোলায় মহারানির
ব্যবহৃত সামগ্রীগুলির উপর। তার লোভ হয়। অসম্ভব এক লুব্ধতা! যদি মহারানির এই সব সামগ্রী সে ব্যবহার করতে পারত তবে বেশ হতো! কিন্তু বাস্তব এই যে কিছুতেই পূরণ হবে না তার এই অকল্পনীয় আশা! কখনও না। আর তাই সে মহারানির ধ্বংস চায়। সে এমন কিছু করবে যাতে নেফারতিতির জীবনে ঘোর অমানিশা নেমে আসে! স্বামীর ভালবাসাও সন্তানদের আনুগত্যে প্রতিদিন সুন্দরতর হয়ে ওঠা পরমাসুন্দরী নেফারতিতিকে সে চরম আঘাত হানবে! আনু সুযোগের অপেক্ষায়
রইল। মেতে উঠল মারণখেলায়। ফারাওয়ের একটি অভ্যাস হল প্রায়ই তার পুত্র-কন্যাদের ডেকে রাষ্ট্র ও ধর্ম সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে
আলোচনা করা। তাদের মতামত নেওয়া। ফারাওয়ের আদেশে মানুষ সূর্যদেব অটেন ছাড়া অন্য কোনও দেবদেবীকে পূজা করতে পারে না। এতে ফারাওয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে উঠছে। এসব কথাই পারিবারিক অলোচনাসভায় বলেন ফারাও। আর এইসব সভায় এক স্বতন্ত্র উপস্থিতির মতো বিরাজ করে রাজকুমার তুতেনখামেন। সে এত রূপবান যে তাকে দেখলে তার দিক থেকে চোখ ফেরানো কঠিন। সব রাজকুমারীরাই তাকে পছন্দ করে কিন্তু তার দৃষ্ টি নিবদ্ধ থাকে একজনের দিকে। সে ফারাওয়ের চতুর্থ কন্যা আঙখেসেনাতন। যতক্ষণ এই যুগল পাশাপাশি বসে থাকে
অপরূপ এক ভাব বিরাজ করে সেখানে। মনে হয় ভালবাসা যেন শত পুষ্পের আকারে ওদেরকে ঘিরে প্রস্ফুটিত হয়েছে। একসঙ্গে
উদ্যানে খেলা, একসঙ্গে শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা, একসঙ্গে পিতার কাছে ধর্ম আলোচনা শোনা। এক মুহূর্ত কেউ কাউকে কাছ ছাড়া করে না। রাজকুমারী আঙখেসেনাতন তুতেনখামেনের প্রতিটি প্রয়োজনে তার পাশে থাকে। আর তুতেনখামেন বোধহয় শয়নে-স্বপনে ধ্যান করে তার সঙ্গীকে। তুতেনখামেন এখনও
কৈশোরে পা দেয়নি আর তার সঙ্গী এক সদ্য কিশোরী। আনু এ বিষয়টি বিশেষভাবেই
নজর করেছে। সে একদিন বিশেষ কৌশলে কথাটি নেফারতিতির কানে তুলে দিল। হলেনই বা মহারানি, নেফারতিতি এই কথা শুনে সপত্নীপুত্রের সৌভাগ্যে ক্রোধে জ্বলে গেলেন। সপত্নীর প্রতি ঈর্ষা যে কোনও নারীর সহজাত। তিনি বললেন, ‘তুই ঠিক জানিস আনু যে তুতেনখামেনের সঙ্গে আমার চতুর্থ
কন্যার বিশেষ বন্ধুত্ব আছে?’ আনু শশব্যস্তে বলে, ‘হ্যাঁ মহারানি। এই বয়সে যতটা সম্ভব।
তবে বুদ্ধিমান মানুষ সকালবেলাতেই বোঝে যে সারাদিনটা কেমন যাবে!’ ‘ওরা কি নিভৃতে সময় কাটায়?’ ‘হ্যাঁমহারানি। খেলা করে,
গল্প করে, এমনকী একে অপরের গলা জড়িয়ে চুমু খায়। আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আর অপরাধ নেবেন না মহারানি, আমি দেখেছি যে ওদের পিতা মানে ফারাও এসব দেখেও কিছু বলেন না। যুবরাজকে প্রশ্রয় দেন।’ ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। চুপ কর তুই। এখনি সব স্তব্ধ করতে হবে। নেফারতিতির এই কন্যাটি নেফারতিতির গর্ভের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাকে অত সহজে তো ও পাবে না।’ নেফারতিতি গর্জে উঠলেন। আনু বলল, ‘মহারানি আমি এ জন্যই আপনাকে সব জানালাম।’ ফারাওয়ের অবর্তমানে নেফারতিতি তার কন্যাদের মধ্যে
একজনকে ফারাও হিসাবে অভিষিক্ত করতে চান। তুতেনখামেনের দাবি অগ্রাহ্য করতে চান তিনি। এখন তুতেনখামেন যদি পরিণত বয়সে ফারাও পদের যোগ্যতম দাবিদারটিকে স্ত্রী হিসাবে পেয়ে যায় তাহলে নেফারতিতি ক্ষমতার অলিন্দে শূন্যতার মধ্যে বিলীন হয়ে
যাবেন। সকলের চোখে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বেন তিনি। তা তো হতে দেওয়া যায় না। কিছুতেই না। নেফারতিতি তা হতে দেবেন না।
আনুকে বিদায় দিয়ে রানি মেরাইবকে ডেকে পাঠালেন। কয়েক দিনের মধ্যেই গোপনে নজরবন্দি করা হল তুতেনখামেনকে। ফারাওকে জানানো হল যে, নেফারতিতি এক
বিশেষ দৌত্যে তাকে দূর দেশে পাঠিয়েছেন। সুন্দরী স্ত্রীর বশীভূত ফারাও বুঝেও না বোঝার ভান করলেন। বন্দিদশায় রাজকুমারের ওপর যথেষ্ট অত্যাচার করা হল। তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করার
চেষ্টা হল যে সে এর পর থেকে কখনও তার সঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না। বালক রাজকুমার ঘৃণা ভরে এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। নিতান্ত অল্প বয়সেও সে জানে যে
কোনগুলি তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জায়গা। পরিণামে মুক্তি পেলেন না তুতেনখামেন। তার প্রতি অত্যাচারের পরিমাণ বাড়ল। নিদারুণ দিন কাটাতে লাগলেন মিশরের বালক যুবরাজ তুতেনখামেন। তার মা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। কেই বা আর তেমন করে তার খোঁজ নেবে? এই সময়েই একদিন ফারাও যখন চূড়ান্ত মত্ত অবস্থায় একাকী
তার কক্ষে রয়েছেন আর মেরাইব নেফারতিতির সঙ্গে পানভোজনে ব্যস্ত, তখন আনু অন্তঃপুরে গিয়ে চুপিচুপি ডেকে আনল
রাজকন্যা আঙখেসেনাতনকে। মেরাইব না থাকায় অন্তঃপুর আজ অভিভাবকহীন। আনু বলল, তুতেনখামেনের ব্যাপারে গোপন
আলোচনার জন্য নাকি পিতা ডেকেছেন তাকে। তুতেনখামেনের কোনও বিপদ
হয়েছে, এ তার চাইতে বেশি আর কেই বা বুঝবে! কিশোরী হলেও মহারানি নেফারতিতিকে সে কিছুটা চিনত। তাই তুতেনখামেনের উল্লেখে এক মুহূর্তদেরি করেনি সে। আনুর পিছুপিছু দ্রুত পায়ে ফারাওয়ের ব্যক্তিগত কক্ষে ঢুকে সে মৃদুস্বরে
বলল, ‘পিতা আমাকে ডেকেছেন আপনি?’ অপ্রস্তুত অবস্থায় এসেছে রাজকুমারী। বক্ষবাস পরিধান করেনি সে আজ। শুধুমাত্র কালাসিরিটি দিয়ে সে তার লজ্জা নিবারণ করেছে। প্রায়ান্ধকার কক্ষে একাকী মত্ত
ফারাও কিছু শুনতে পেলেন না। দেখতে পেলেন না। শুধু শরীরের মধ্যে টের পেলেন এক প্রবল ক্ষুধার অস্তিত্ব। কেউ একজন প্রবল এক ধাক্কায় তাকে ফারাওয়ের বুকের ওপর ফেলে দিল। নিভিয়ে দিল ঘরের একমাত্র প্রদীপটি। ফারাও সবলে আলিঙ্গন
করলেন তাকে, প্রবল এক চুম্বনে স্তব্ধ করলেন তার ওষ্ঠ। মত্ত পুরুষ প্রমাণ করল তার পৌরুষ। আনু বন্ধ দরজার বাইরে পাহারায় রইল। রাজকুমারী জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।ফারাওয়ের দীর্ঘদেহ অপচ্ছায়ার মতো ঢেকে দিল মাটি থেকে আকাশ। কিশোরী আঙখেসেনাতন তার মাঝখানে হারিয়ে গেল। চাঁদ অস্ত গেল। তারাগুলি লজ্জায় মুখ লুকাল। প্রাসাদের বাইরের পৃথিবীতে ঝড় উঠল। সেই ঝড়ে নিভে গেল বালক রাজকুমারের কারাকক্ষের একমাত্র প্রদীপটিও। বন্দিত্ব থেকে মুক্তি হল না তুতেনখামেনের। বন্দি করা হল আঙখেসেনাতনকেও। দীর্ঘদিনের কারাবাস। বন্দিদশায় দেহে-মনে অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে
একটি মৃত কন্যাসন্তানের জন্ম দিল সে। কেউ কোনও প্রশ্ন তুলল না। সব বুঝেও নেফারতিতি একটি দিনের জন্য কন্যাকে কারাগারে দেখতে এলেন না। স্তব্ধতা বিরাজ করল সর্বত্র। ফারাও ঈশ্বরের প্রতিনিধি। সূর্যদেব অটেনের প্রতিনিধি। প্রকাশ্যে
ফারাওয়ের সমালোচনা করা যায় না। অজস্র গুঞ্জনে পরিপূর্ণ হল আমারনার বিলাসবহুল প্রাসাদ। নেফারতিতির স্বপ্নের প্রাসাদ। ভাঙল সব স্বপ্ন! ভেঙে খানখান হয়ে গেলেন নেফারতিতি। বহু মানুষের মৃত্যুদ ণ্ড হল। বাদ গেল না আনুও! নেফারতিতির আদেশে
অশেষ যন্ত্রণা পেয়ে মারা গেল সে। নেফারতিতির স্বপ্ন ভাঙলেও সে আজ সুখী। সব অভিলাষ পূর্ণ হয়েছে তার। অল্পদিনের মধ্যেই প্রাণত্যাগ করলেন ফারাও নিজেও। হঠাৎই অজস্র রোগ এসে বাসা বাঁধল তার শরীরে। ফারাওয়ের মৃত্যুর পর পুরুষের ছদ্মবেশে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিলেন মহারানি নেফারতিতি। তবে ইতিহাস বলে যে, এই দুই
ভাগ্যপীড়িত রাজকুমার ও রাজকুমারী
পরবর্তীকালে নিজেদের শৈশবের ভালবাসা অটুট রাখতে পেরেছিল। যে কোনও পরিস্থিতিতেই পরস্পরকে ভালবাসার সত্য থেকে কখনও সরে আসেনি তারা। কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিলেন নেফারতিতি। তুতেনখামেন হয়েছিলেন মিশরের ফারাও আর তার একমাত্র প্রিয়তমা মহিষী হয়েছিলেন আঙখেসেনাতন। রাজা তার নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে রানির একটি নতুন নাম দিয়েছিলেন। অনেক ভালবাসার প্রতীক সে নামটি হল আঙখেসেনামুন।
কিশোর রাজা আর তার কিশোরী বধূ পরস্পরকে ভালবেসে রাজপ্রাসাদে
পেতেছিল তাদের খেলাঘরের রাজকীয় সংসার।

——নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্রমোদীর অফিসে রাহুল গান্ধি, সঙ্গে মজুত ছিলেন দেশের প্রধান বিচারপতিও!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-নতুন সিবিআই কর্তা নিয়োগ করতে হবে আর সেই উদ্দ্যেশ্যেই লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল…

2 hours ago

ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে ইন্ডিয়ান আইডল জয়ী পবনদীপ,অবস্থা আশঙ্কাজনক!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে ইন্ডিয়ান আইডল জয়ী সিজন ১২ এর পবনদীপ রাজন ৷ উত্তর…

9 hours ago

শবরীমালা মন্দির পরিদর্শনে দ্রৌপদী মুর্মু!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-আগামী ১৮ মে দু'দিনের জন্য কেরল সফরে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ৷ সেই…

11 hours ago

মহাকালেশ্বর মন্দিরে বীভৎস আগুন!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-উজ্জ্বয়ন মহাকালেশ্বর মন্দিরে বিভীষিকাময় আগুন। মন্দিরের উপর থেকে গলগল করে নির্গত হচ্ছে কালো…

11 hours ago

হত্যা মামলায় ‘গ্রেপ্তার’ বাংলাদেশে জেলবন্দি চিন্ময় প্রভু!

অনলাইন প্রতিনিধি :-জেলবন্দি সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী ওরফে চিন্ময় প্রভুকে নতুন করে আবার হত্যা…

12 hours ago

নিখোঁজ হয়ে ছিলেন কুড়ি বছরে বাড়ি ফিরে এলেন ৬৩ বছর পর!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্য থেকে প্রায় ৬৩ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন অড্রে ব্যাকেবার্গ নামে…

12 hours ago