দুই–তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে ফের ত্রিপুরায় সরকার গড়ছে বিজেপি

 দুই–তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে ফের ত্রিপুরায় সরকার গড়ছে বিজেপি
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

গত ১৮ ডিসেম্বর রাজ্যে এসে গেরুয়া পালে হাওয়া তুলে দিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নতুন বছরের শুরুতে বৃহস্পতিবার রাজ্যে এসে বিজেপির সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সেই হাওয়াকে আরও তেজি করলেন। রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এ দিন ত্রিপুরার দুই প্রান্তে (উত্তর ও দক্ষিণ) দুটি ‘জন বিশ্বাস যাত্রা’র সূচনা করলেন তিনি। আর এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ধর্মনগর ও সাব্রুমে আয়োজিত হয় জনসমাবেশ।

সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিপ্লব কুমার দেব ও ডা. মানিক সাহার মুখ্যমন্ত্রিত্বে বিজেপি-আইপিএফটি সরকারের উন্নয়নকে সামনে রেখে পুনরায় আগামী পাঁচ বছরের জন্য ত্রিপুরায় ভাজপা সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানালেন রাজ্যবাসীর কাছে। তার দাবি, পাঁচ বছর বিপ্লব-মানিকের নেতৃত্বে যে বিকাশ হয়েছে, সেটা শুধু টেলার। অমিতের ভাষায়, ‘ইয়ে তো টেলার হ্যায়, পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। দুই জনসভাতেই অমিতের মুখে ত্রিপুরার বিকাশ থেকে শুরু করে কাশ্মীর, ৩৭০ ধারা, রামন্দির, সার্জিকেল স্টাইক, রাহুল, মায়া, মমতা, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট সবই উঠে এসেছে।

শুধু তাই নয়, তাৎপর্যপূর্ণভাবে অমিত শাহের মুখে বারবারই উঠে এসেছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহার নাম ৷ ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে প্রথম কোনও কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করে ত্রিপুরায় ভাজপা সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। অমিতের দাবি, ভারতীয় রাজনীতিতে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বিপ্লব কুমার দেব যে কাজ করেছেন, তার ভূয়শি প্রশংসা করেন অমিত শাহ । বিপ্লবকে জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে যাওয়ার পর সেই কাজকে সাফল্যের সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ডা. মানিক সাহা। অমিত শাহের দাবি, বিপ্লব দেব মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কারও হিম্মত হয়নি রাজ্যে হিংসা, তোলাবাজি করার।

বুধবার রাতেই আগরতলা আসার
কথা ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্টমন্ত্রী অমিত শাহের। সেই মতো যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া ছিল। কিন্তু বুধবার রাতে এমবিবি বিমানবন্দরে ঘন কুয়াশার কারণে অমিত শাহকে নিয়ে আসা ভারতীয় বায়ুসেনার বিশেষ বিমান অবতরণ করতে পারেনি। বিমান ঘুরে চলে যায় গুয়াাটিতে। বুধবার গুয়াহাটিতে রাত্রিযাপন করে বৃহস্পতিবার সকালে আগরতলা আসেন। কিন্তু সকালেও কুয়াশার কারণে বিমান নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই ঘণ্টা পরে আগরতলা অবতরণ করে।

বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহা, উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মণ, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী প্রতিমা ভৌমিক, বিজেপি প্রদেশ সভাপতি রাজীব ভট্টাচার্য, বিজেপি রাষ্ট্রীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্ৰা প্রমুখ। বিমানবন্দর থেকে বায়ুসেনার কপ্টারে বর্তমান ও প্রাক্তন দুই মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখপাত্র সম্বিত সম্বিত পাত্রকে নিয়ে ধর্মনগরের উদ্দেশে রওনা হন অমিত শাহ। পবন হংসের কপ্টারে ধর্মনগর যান উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মণ, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী প্রতিমা ভৌমিক এবং বিজেপি প্রদেশ সভাপতি রাজীব ভট্টাচার্য।

ধর্মনগর পৌঁছে প্রথমে স্থানীয় বিবিআই স্কুল মাঠে আয়োজিত জনসভাবেশে ভাষণ দেন। এরপর দলীয় পতাকা নেড়ে ‘জনবিশ্বাস যাত্রা’ নামক রথযাত্রার সূচনা করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ অন্যরা। ধর্মনগর থেকে সুসজ্জিত পনেরোটি রথ (গাড়ি) আগামী সাতদিন ৩০টি বিধানসভা কেন্দ্র পরিক্রমা করে ১১ জানুয়ারী আগরতলায় আসবে। ধর্মনগরে আয়োজিত বিশাল সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মাঠে জনতার উপস্থিতি দেখে বলেন, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ত্রিপুরায় দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসবে। এটা নিশ্চিত।

কমিউনিস্ট শাসনে ত্রিপুরায় যে হিংসার রাজনীতি কায়েম করা হয়েছিল, বিপ্লব কুমার দেবের নেতৃত্বে বিজেপি সরকার সেই হিংসাকে প্রতিরোধ করে রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে এনেছে। শুধু তাই নয়, বিজেপি সরকার ড্রাগস ও নেশার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ত্রিপুরার রাজাদের সম্মান জানান এবং ত্রিপুরা রাজ্যকে ভারতবর্ষের সাথে যুক্ত রাখার জন্য মাহারাজ বীরবিক্রম মাণিক্যকে প্রণাম জানান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে রাজ্যের রাজ পরিবারের গভীর সম্পর্ক এবং সঙ্গীত জগতের প্রখ্যাত গায়ক শচিন দেববর্মণের নাম উল্লেখ করে তার প্রতিও শ্রদ্ধা জানান।

তিনি প্রদেশ বিজেপি ইউনিটকে জন বিশ্বাস যাত্রা নাম রাখার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেই ভোটে জেতা যায়। তিনি জানান, ২০১৮ সালে রাজ্যে একটি সভা করতে এসে সেখানে এগারো জন উপস্থিত ছিলেন। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, এই রাজ্য থেকে কমিউনিস্টদের কুশাসন থেকে মুক্ত করবেন। সেই সময় তিনি চলো পাল্টাইয়ের আওয়াজ তুলেছিলেন। রাজ্যের মানুষ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে রাজ্যের বিজেপি সরকার প্রতিষ্টা করেছে। তিনি বলেন, যে রাজ্যে দলের একটিও বিধায়ক ছিল না, সেই রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ তৈরি করে দিয়েছে মানুষ, যা তিনি কোনওদিন দেখেননি।

এরজন্য রাজ্যবাসীকে ধন্যবাদ জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বর্তমানে রাজ্যে ডবল ইঞ্জিনের সরকার চলছে। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজ্যবাসীকে বিজেপি সরকার গঠন করার পরিবর্তে হীরা উপহার দেওয়ার কথা বলেছিলেন। হীরা মানে হাইওয়ে, ইন্টারনেট, রেলওয়ে ও এয়ারওয়ে। বিপ্লব দেব মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্যের মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। বর্তমান ডা. মানিক সাহা রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কথা উল্লেখ করে বলেন, এ রাজ্যে মানুষ আগে হীরা পেয়েছে এবার বাড়তি মানিক পেলো। রাজ্যে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর এনএলএফটি জঙ্গি সংগঠনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান সহ ব্রু পরিবারকে রাজ্যে স্থায়ী বাসস্থান দিয়ে তাদের কাজ করেছে।

বিজেপি বিগত পাঁচ বছরে রাজ্যে অন্ধকারের জায়গায় অধিকার, বিনাশের জায়গায় বিকাশ, বিবাদের জায়গায় বিশ্বাস, কুশাসনের জায়গায় সুশাসন এর দুবিধার জায়গায় সুবিধা দেওয়ার কাজ করেছে। প্রধানমন্ত্রী জল, জঙ্গল ও জমি রক্ষা করার কাজ করছেন। বিগত পাঁচ বছরে রাজ্যে বিজেপি সরকার ২ লাখ ৭০ হাজার পরিবারের মহিলাদের হাতে গ্যাস সিলিণ্ডার তুলে দিয়েছে। সোয়া চার লাখ ঘরে প্রতিস্রুত পানীয় জলে পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান তিন লাখ আশি হাজার ঘরে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দশ হাজার কোটি টাকার উপর সড়ক থেকে শুরু করে অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণের কাজ করা হয়েছে।

এছাড়া আড়াইশ কোটি টাকার দুইশ বাষট্টি কিলোমিটার লম্বা হাইওয়ে নির্মাণের কাজ করা হয়েছে। ৭৩ হাজার মায়েদের মাতৃবন্ধন ভাতা প্রদান করা হয়েছে। সতেরো একলব্য মডেল স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে। দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার কৃষকদের প্রতি বছরে ৬ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। এক লাখ ত্রিশ হাজার পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।তেরো লাখ মানুষকে পাঁচ লাখ টাকার স্বাস্থ্য বিমা কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। করোনা মহামারি থেকে দেশকে রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৩০ কোটি ভারতীয়কে বিনামূল্যে কোভিড টিকা প্রদান করা হয়েছে। আশি কোটি পরিবারকে বিনামূল্যে পাঁচ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে।

রাজ্যের ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিভিন্ন খেলার মাঠ নির্মাণের জন্য কেন্দ্র থেকে ১৫ কোটি টাকা রাজ্যকে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ার বাইছে। তিনি এ দিন বিরোধী সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস দলের তীব্র সমালোচনা করে বলেন। তাই তিনি সকলকে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে পদ্ম চিহ্নে ভোট দিয়ে বিজেপিকে জয়যুক্ত করার আহ্বান রাখেন। সাব্রুমে জনসমাবেশে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরার উন্নয়নে সাব্রুম আগামী দিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।মৈত্রী সেতু, আইসিপি রাজ্যের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব পাবে। তাছাড়া পর্যটন শিল্প কমিউনিস্ট শাসন থেকে এগারো গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিজেপি জোট শাসনে রাজ্যে পরিকাঠামো উন্নয়ন থেকে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। রাজ্য ২ লক্ষ ৭০ হাজার ঘরে উজ্জ্বল যোজনার সুযোগ পেয়েছে। মহিলাদের ৩৩ শতাংশ চাকরি ক্ষেত্রে সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ সিপিএমকে তাক করে বলেন, চাঁদাবাজি, তোলাবাজি ও খুন সন্ত্রাস এদের ধারাপাতে লেখা। ত্রিপুরাকে ২০১৮-তে সন্ত্রাসমুক্ত করা হয়েছে। তাদের আর সে সুযোগ না দিতে জনগণের কাছে আহ্বান করেন। অমিত শাহের ভাষণে অনেকটা সময় জুড়ে জাতীয় প্রসঙ্গে প্রাধান্য পায়, তিনি বলেন, কাশ্মীর আমাদেরই। কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলা হয়েছে।

পাক উগ্রবাদী কার্যকলাপের জবাব দেওয়া হয়েছে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মাধ্যমে। তিনি বারে বারে বলেন, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আছে বলে তা সম্ভব হয়েছে। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া হয়েছে। দেশের সংসদের ভেতরে বাইরে দেশের বিরোধী শিবিরের নেতারা বহু চিৎকার চেঁচামেচি করেছিল কিন্তু কিছুই হয়নি। শাহ্ আজ রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করতে ভুল করেনি। সাব্রুমের কলেজ মাঠে দাঁড়িয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং থেকে সোনিয়া গান্ধী সকলকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। অমিত শাহ বলেন, আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশের রাম মন্দিরের সূচনা হবে।

দুটি সমাবেশে অমিত শাহ ছাড়াও ভাষণ রাখেন মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহা, উপ- মুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মণ, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব, বিজেপি প্রদেশ সভাপতি রাজীব ভট্টাচার্য। দুটি সভাতেই জেলার সকল বিধায়ক, নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ দিন সন্ধ্যায় বিশেষ বিমানে অমিত শাহ ইম্ফল চলে যান।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.