দুই মিছিল, ভিন্ন
২৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার একই দিনে মিছিলের দুইটি মিছিল ও সভার সাক্ষী রইল আগরতলা। একটির আয়োজক ছিল ক্ষমতাসীন বিজেপি।দলের জনজাতি মোর্চা এবং অন্যটির কৃতিত্ব কংগ্রেস। পৃথক দল এবং ইস্যুও ভিন্ন। তথাপি দুই মিছিল – সভা রাজ্যরাজনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই গণ্য হতে বাধ্য। রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরেই প্রায় ভূমিকাহীন বলা চলে। বিক্ষিপ্ত কিছু কর্মসূচি ছাড়া তাদের অস্তিত্ব অনুভব করাই কঠিন ছিল।বৃহস্পতিবার মিছিল ও জনসভার পর সেই ধারণা কিন্তু অনেকটাই পাল্টে গেছে। বড় সংখ্যায় দলীয় কর্মীদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে যে রাজ্যে কংগ্রেস নিঃশেষ হয়ে যায়নি এবং দল রাজ্যে জেগে উঠছে। একই দিনে অন্য যে মিছিল ও সভা শহরবাসী দেখল তাও কিন্তু রাজ্য -রাজনীতিতে আগামী দিনের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বহন করছে। বিগত জেলা পরিষদ নির্বাচনের পর থেকেই রাজ্যে এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে পাহাড় বোধ হয় “বুবাগ্রা” প্রদ্যোত বিক্রম কিশোর দেববর্মণের কব্জায় চলে গেছে। সেখনে অন্য কারও দাঁত বসানোর কোন সুযোগ নেই। বিজেপি জনজাতি মোর্চার মিছিল ও সভার পর কিন্তু সেই ধারণা বড় রকম ধাক্কা খেয়েছে। এই দুই মিছিল ও সভার পর সব রাজনৈতিক দলকেই তাদের নির্বাচনি কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। দলের প্রাপ্ত ভোট নেমে এসেছিল দুই শতাংশের নিচে। পরবর্তী সময়ে লোকসভা নির্বাচনে অবস্থার কিছুটা হার উন্নতি ঘটে। ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে ভোটের হার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৩ শতাংশ। ভোটের হার বাড়লেও দল কিন্তু কোন পর্যায়েই বড় কোন সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দিতে পারেনি।বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থানে কিছু কর্মসূচি পালিত হলেও কংগ্রেস দল হিসাবে কখনই নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিতে পারেনি। বৃহস্পতিবারের মিছিল ও সভায় দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের ব্যাপক উপস্থিতি কিন্তু সেই ধারণা অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। কংগ্রেস বরাবরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্য পরিচিত। কিন্তু এই মিছিল প্ৰদেশ কংগ্রেস সভাপতি বীরজিৎ সিন্হা,সুদীপ রায়বর্মণ, গোপাল রায়, আশিস সাহা সহ প্রবীণ নেতা সমীর রঞ্জন বর্মণরা পাশাপাশি হেঁটে ঐক্যের একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নেতাদের এই প্রয়াস দলীয় কর্মীদের মধ্যে যদি একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে তবে তাই হবে কংগ্রেসের জন্য মঙ্গল ।
দ্বিতীয় যে মিছিল ও সভা শহরবাসী দেখল বিজেপি কিন্তু তার আয়োজক ছিল না।এর উদ্যোক্তা ছিল দলের একটি মোর্চা মাত্র।জনজাতি মোর্চা। একটি মাত্র মোর্চার আয়োজন হলেও রাজ্য রাজ্যনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা কিন্তু অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।মিছিলের পুরোভাগে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যসভা সদস্য বিপ্লব কুমার দেব, প্রদেশ সভাপতি রাজীব ভট্টাচার্যরা উপস্থিত থাকলেও মিছিল আয়োজনের মূল কৃতিত্ব কিন্তু ছিল রেবতী ত্রিপুরা, বিকাশ দেববর্মাদের।এই মিছিলের সাফল্য বিচার করতে গিয়ে কেউ কিন্তু একই দিনে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের মিছিলের সঙ্গে তার তুলনা করেননি। মিছিলের সাফল্য বিচারে তুলনা টেনেছেন আস্তাবল ময়দান আয়োজিত প্রদ্যোত বিক্রম কিশোরের জনসভার সঙ্গে। বিজেপি জনজাতি মোর্চা আয়োজিত জনসভার সাফল্য বিচারের তাৎপর্যটাও কিন্তু সেখানেই।জেলা পরিষদ নির্বাচনে ১৮টি আসন নিয়ে তিপ্ৰা মথা এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বিজেপি কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বরং ভালোই ফল করেছে বলতে হবে। এককভাবে দল পেয়েছে দশটি আসন। এই ফল সত্ত্বেও এতোদিন জেলা পরিষদ এলাকায় বিজেপি কেমন যেন মিইয়ে থেকেছে। রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ব্লক ডেভেলপমেন্ট কমিটি গঠন করে দিলেও কখনই তাদের যথেষ্ট কার্যকর করতে পারেনি। বার বারই তিপ্রা মথার হুমকির মুখে পিছু হটতে হয়েছে। খুমুলুঙ-এ দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডার জনসভাতেও ভালো সংখ্যায় জনজাতিদের শামিল করতে পারেনি। মাত্র কয়েকদিন আগে গত ৫ ডিসেম্বর আস্তাবল ময়দানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনসভায় জনজাতিদের উপস্থিতিও তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। সামগ্রিকভাবে পাহাড়ে বিজেপি দলের সাংগঠনিক শক্তির অভাব ও মানসিক দুর্বলতার লক্ষণগুলিই প্রকটিত হয়ে উঠছিল।সামগ্রিক এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটেই বৃহস্পতিবারের মিছিল ও জনসভায় উপস্থিতির বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে একটা মোটামুটি উপস্থিতিই জনসভার সাফল্য এনে দিতে পারতো। কিন্তু এই মিছিল ও জনসভা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠার প্রধান কারণটা হল এর ব্যাপক উপস্থিতি। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল উপস্থিতির বিচারে কেউ কিন্তু এই জনসভার সঙ্গে কংগ্রেসের জনসভার তুলনা টানছেন না। বরং প্রদ্যোত বিক্রমের নেতৃত্বাধীন তিপ্রা মথার আস্তাবলে আয়োজিত বিশাল জনসভার সঙ্গেই তার তুলনা টানছেন। এটা ঠিক যে বৃহস্পতিবারের উপস্থিতি তিপ্রা মথা আয়োজিত জনসভাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। তাসত্ত্বেও মানুষ যে দুইয়ের মধ্যে তুলনা টানছেন এটাই কিন্তু বড় কথা। পাহাড়ে যে বিজেপির জনজাতি মোর্চা জেগে উঠছে এটা তার প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। বিজেপি প্রথম থেকেই প্রদ্যোৎ বিক্রমের সঙ্গে একটা সমঝোতার প্রয়াস চালিয়েছে। পাহাড়ে যে তারা শক্তির মহড়ায় যায়নি এটাও হয়তো ছিল তার কারণ। সেই সমঝোতার সম্ভাবনা বিলীন হতেই দল শক্তির মহড়ায় নেমে পরেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহ এই প্রয়াস জারি থাকলে বিধানসভা ভোটের ফলে যে তার প্রভাব পরবে তা কিন্তু নিশ্চিত করেই বলা চলে।বিজেপি, কংগ্রেস ও তিপ্ৰা মথাকে কেন্দ্ৰ করে রাজ্যে নতুন যে সমীকরণ চলছে তা ভিত্তিতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তাদের নির্বাচনি পূর্বাভাস নতুন করে পর্যালোচনা করতে শুরু করেছেন। এই পর্যালোচনায় নতুন একটি দিক উঠে আসছে। দেখা যাচ্ছে এই তিন দলের নতুন সমীকরণের জেরে চতুর্থ একটি দলের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সেই দলটি হল সিপিআই (এম) মাত্র দুইদিন আগে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি প্রচার করেছে বিজেপির আক্রমণাত্মক হাত থেকে আত্মরক্ষাই ছিল এর মূল প্রতিপাদ্য। আপাতত বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও অনেকেই কিন্তু একে আগামী নির্বাচনে জোট গঠনের প্রস্তুতি বলেই ধরে নিয়েছিলেন। দল সমূহের নেতারাও তেমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। যার ভিত্তিতে অনেকই সম্ভাব্য আসন ভাগাভাগি নিয়ে হিসাব নিকাশ শুরু করে দিয়েছিলেন। উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতিতে সেই হিসাবেও কিন্তু ওলোট পালোট হয়ে যেতে পারে। বৃহস্পতিবারের সফল প্রদর্শনের ধারা অব্যাহত থাকলে আসন ভাগাভাগির সময় কংগ্রেসের দর কষাকষির ক্ষমতা অনেকটাই বেড়ে যাবে। এনিয়ে সিপিএম নেতাদের নিশিচতভাবেই দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে। তাছাড়াও এবারে জোটের রাজ্যনীতিতে নতুন শরিক হতে চলেছে সিপিআই (এমএল) লিবারেশন। সবদলকে কাছাকাছি আনার ক্ষেত্রে নকশালপন্থী এই দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বস্তুত এই দলের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মঞ্চ ভাগাভাগির মধ্য দিয়েই জিতেন সুদীপরা যৌথ বিবৃতির পায়তারা শুরু করেছিলেন। এখন আসন ভাগাভাগির সময় এই দলকে তার ভাগ অবশ্যই দিতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকেই ত্রিপুরার রাজনীতি দীর্ঘদিন কংগ্রেস ও সিপিআই(এম)র মধ্যে সরাসরি বিভাজিত থেকেছে। সমতলে ক্ষমতার অদল বদল হলেও পাহাড়ে সিপিএম সব সময়ই ছাড়ি ঘুরিয়েছে। এখন বিজেপি বা তিপ্রা মথার মতো নতুন খেলোয়াড়দের আগমনে পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে। আগামী বেশ কিছুদিন যে রাজ্য রাজনীতির ধারা ভিন্ন খাতেই প্রবাহিত হবে তা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে।