দুই সাংমার দ্বৈরথ দেখতে মুখর মেঘালয়!

 দুই সাংমার দ্বৈরথ দেখতে মুখর মেঘালয়!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

জার্সি পাল্টালে কি খেলোয়াড়ের উৎকর্ষ নষ্ট হয়ে যায়? বার্সেলনায় দীর্ঘ বছর সেরা ফর্মে খেলার পর লিওনেল মেসি এই যে পিএসজির জার্সিতে খেলছেন, উৎকর্ষে ভাটা পড়েছে কি! পড়েনি। তাহলে মুকুল সাংমারই বা পড়বে কেন ? কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম ! কোথায় মেসি, আর কোথায় মুকুল।কিন্তু মেঘালয়ে মুকুল সাংমা এতটাই জনপ্রিয় যে, তেইশ বছর কংগ্রেসের ঘর করার পর গত বছর এখন তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়েও প্রচারে ভেলকি দেখাচ্ছেন গারো পাহাড় থেকে শুরু করে জয়ন্তীয়া, খাসি পাহাড়ে। এই তিন পাহাড়ি অঞ্চল নিয়েই সাবেক মেঘালয় রাজ্য। রাজনীতির পাশাপাশি চিকিৎসাও তার পেশা। তিনি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। ১৯৯০- তে ডাক্তারি পাসের পর ৯৩ সালে নির্দল প্রার্থী হিসাবে গারো পাহাড়ের কোলে আমতাগিরিতে প্রার্থী হয়েই বিধায়ক নির্বাচিত হন। সেই শুরু। ৯৮ সালে কংগ্রেসের প্রতীকে দ্বিতীয়বার জয়। তারপর পর্যায়ক্রমে ২০০৩, ২০০৮, ২০১৩ এবং ২০১৮- তে হারের মুখ দেখেননি মুকুল। তার মধ্যে ২০০৩ থেকে রাজ্যের মন্ত্রী। ২০০৫- ১০ উপ-মুখ্যমন্ত্রী। ২০১০-১৮ টানা আট বছর মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীত্বের সূত্রে তার ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়। সব মিলিয়ে পূর্ব গারো জয়ন্তিয়া পাহাড়ে মুকুলের দারুণ প্রভাব। অন্যদিকে, যেহেতু কলেজ জীবনে তার মাস্টারমশাই ছিলেন কনরাডের পিতা পিএ সাংমা, সেই সূত্রে রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও দুই সাংমা পরিবারের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্কের রসায়ন মধুর। ২০১৮ থেকে অধুনা মুকুল বিরোধী দলনেতা। গত বছর নভেম্বরে এগারোজন কংগ্রেসের বিধায়ক সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন। যদিও দলবদল রাজনীতির এই মুক্তাঞ্চলে তিনি সকলকে ধরে রাখতে পারেননি। এক বিধায়ক তৃণমূল ছেড়ে তরি ভিড়িয়েছেন এনপিপিতে, বাকি দুজন বিদায়ী জোট সরকারের সেজ শরিক ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (ইউডিপি) এবং গেরুয়া শিবিরে যোগ দিয়েছেন।এমন রাজ্যও হয়তো দ্বিতীয়টি নেই যেখানে গত পাঁচ বছর যে পাঁচ দলে একত্রিত হয়ে মেঘালয় ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এমডিএ) গঠন করে রাজ্যপাট চালালো, এই ভোটে তারা কেউ কারোর সঙ্গে নেই। সকলে একা লড়ছে এবং বিজেপি সহ বাকি তিনদলও প্রচারে সর্বক্ষণ এমডিএ সরকারকে দুর্নীতিবাজ বলে বাপ-বাপান্ত করছে। সোমবার একটা ট্যাক্সি নিয়ে শিলংয়ের অন্তত চারটি বিধানসভা কেন্দ্র ঘুরে, বিভিন্ন মানুষ এবং নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেলো, তার নির্যাস, মেঘালয়ে মেসির চেয়ে কম জনপ্রিয় নন ৫৭ বছরের মুকুল। অধিকাংশ ভূমি পুত্র-কন্যা তার সম্পর্কে বলেন, শুধু জার্সিটা বদলেছে, খেলোয়াড় তো একই। তবে মুকুলের প্রধান প্রতিপক্ষ রাজ্যের শাসক দল ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) শিলংয়ের জেলা সভাপতি সারলিং লিংডো কটাক্ষ করে বলেন, মুকুল সাংমা মানে তৃণমূল! তৃণমূল মেঘালয়ে মাত্র পনেরো মাসের দল। ১৯৯৭ থেকে এখানে বিজেপির মতো সর্বভারতীয় দল পার্টি করছে। তারাই কিছু করতে পারলো না, সেখানে তৃণমূল আবার কী? আমাদের এবার মূল প্রতিপক্ষ বিজেপি। তৃণমূল পাঁচটির বেশি আসনে জিতবে না। শারলিং তৃণমূল সম্পর্কে যতই কটাক্ষ করুন, এবার মেঘালয়ে মূল লড়াই এনপিপি বনাম তৃণমূলের। অন্যদিকে মুকুলও সংবাদ মাধ্যমের সামনে দাবি করেছেন, গারো পার্বত্য এলাকায় খুব বেশি হলে পাঁচটি আসনে জিতবে এনপিপি। এনপিপি যদি খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ি অঞ্চলে ক্ষমতাধর হয়, তবে মুকুলের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল গারো পাহাড়ে, মানে বাংলাদেশের ময়মনসিং ও সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। খাসি ও জয়ন্তিয়া পার্বত্য এলাকা মিলিয়ে এখানে ত্রিশটি আসন, বাকি ত্রিশটি আসন গারো পাহাড়ের কোলে। আদতে এনপিপি বনাম তৃণমূল নয়, মূল লড়াইটা মুকুল বনাম এনপিপি সুপ্রিমো তথা বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার। কেন্দ্র থেকে পাঠানো অর্থই মেঘালয়ের চালিকাশক্তি। গত ষোল তারিখ তুরার জনসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলে গেছেন, ইউপিএ জমানার দশ বছরে মেঘালয়ে কেন্দ্র থেকে অনুদানের পরিমাণ ছিল সাকুল্যে ১৩০০০ কোটি টাকা। সেখানে গত আট বছরে মোদি সরকার এ রাজ্যে পাঠিয়েছে ২২০০০ কোটি টাকা। বিদায়ী সরকারের শরিক থাকলেও অমিত শাহ একই সঙ্গে তুরার সভায় বলেছেন, বিগত পঞ্চাশ বছরে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে রাজ্যে দুর্নীতি হয়েছে তার নাম মেঘালয়। গত পঞ্চাশ বছরে মেঘালয়ে একটাও মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়নি। সেখানে আসামে গত পাঁচ বছরে পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। মেঘালয়ের জন্য কেন্দ্র দুটি মেডিক্যাল কলেজের টাকা পাঠিয়েছিল, কিন্তু রাজ্য সরকার তা গড়তে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতায় এলে গারো পাহাড়ে মেডিক্যাল কলেজ গড়ে দেবে বিজেপি সরকার। তবে ৭৫ শতাংশ খ্রিস্টান নাগরিকের এই রাজ্যে বিজেপি একার বলে অন্তত এই ভোটে গদিতে বসবে বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনের পর ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হলে গতবারের মতো ফের কোনও জোটসঙ্গী তৈরি করে ডবল ইঞ্জিন তত্ত্বে হয়তো সেই সরকারের স্টিয়ারিং হতেই পারে বিজেপি। গতবার মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল বিজেপি। তাতেই হিমন্ত বিশ্বশর্মার সফল দৌত্যে একুশ আসন পাওয়া কংগ্রেসকে বৃত্তের বাইরে ঠেলে দিয়ে এনপিপি, ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (পিডিএফ) এবং হিলস স্টেট পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এইচএসপিডিপি)কে নিয়ে মেঘালয় ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এমডিএ) তৈরি করে সরকারের শরিক হয় বিজেপি। প্রথমবার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েই সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন মেঘালয়ের অবিসংবাদী নেতা প্রয়াত পিএ সাংমার কনিষ্ঠ পুত্র কনরাড সাংমা। শিলংয়ে দলের মুখ্য কার্যালয়ে বসে শারলিং বলেন, হোয়াট ইজ ইলেকশন কমিশন, দেশকে বুঝিয়েছিলেন টিএন সেশন। হোয়াট ইজ দ্য রোল অফ ইণ্ডিয়ান প্রেসিডেন্ট, বুঝিয়েছিলেন আব্দুল কালাম। ঠিক তেমনই লোকসভার স্পিকারের ভূমিকা কী, প্রথম বুঝিয়েছিলেন আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা পিএ সাংমা। ৪৪ বছরের কনরাড তারই সুযোগ্য পুত্র। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং লণ্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সের প্রাক্তনী।মেঘালয় রাজ্যের ইতিহাসে তিনি সর্বকনিষ্ঠ অর্থমন্ত্রী। তার দিদি আগাথা সাংমা এনপিপি সাংসদ। গত পাঁচ বছরে কনরাড সরকারের বিরুদ্ধে যতই দুর্নীতির অভিযোগ উঠুক না কেন, মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি অপাপবিদ্ধ। এ রাজ্যের রাজনীতির কুশীলবরা বলেন, দোষ কনরাডের নয়, যত দোষ তার দাদা জেমস সাংমার। গত দশ বছরের বিধায়ক, তবু ২০১৬ সালে বাবার মৃত্যুর পরে দলের ব্যাটন উঠে আসে ভাই কনরাডের হাতে। এখানে বলে, জেমস চতুর নেতা। দুর্নীতির শিরোমণি। সেই কারণে একটি দপ্তরে কখনও ছয় মাসের বেশি মন্ত্রিত্বে থাকতে পারেনি। সেখানে কনরাড নট আ গুড পলিটিশিয়ান,বাট আ গুড হিউম্যান বিয়িং,আ ডিসেন্ট পার্সন। ভোটের বাজারে টাকা উড়ে উড়ুক, কিন্তু ভাবমূর্তির জায়গা থেকেই কনরাড বনাম মুকুল, এবার দুই সাংমার দ্বৈরথ দেখতে মুখর হয়ে আছে মেঘালয়।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.